জীবন আবহমানl এই আলো হাওয়া নদীর সংসারে
দৃষ্টি প্রসারিত করে দাঁড়ায় মহাকাল l সময়ের সরনী বেয়ে যে সমস্ত মানব-জীবন বাংলা সাহিত্য
এবং এই গতানুগতিক যাপনের এক নতুন দিক নির্দেশ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় l তাঁর কবিতার শরীরেজুড়ে এক দৃঢ় মানবিক চেতনা, এই তীব্র আর্থ-সামাজিক
ও রাজনৈতিক হননকালের প্রতি তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ, আর অদ্ভুত এক মাধুর্য ও বাস্তবতার মিশেলl
তাই সেগুলো অনায়াসে হয়ে উঠেছে এক অসামান্য জীবন-দাস্তানl
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে
"কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে ব’লে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমনীকে বুকে টানে ; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।
"
এ এক আলোয় ফেরার উপাখ্যান l এই 2019 এ দাঁড়িয়েও
যা সমকালীন, প্রাসঙ্গিক l যে ভয়াবহ অন্ধকার প্রতিনিয়ত আমাদের সুচেতনা, বিবেক ও মনন
কে গ্রাস করে চলেছে, তার প্রকোপে আমরাও দিকভ্রান্তl কবিতা মাত্রই সমাজের জীবন্ত দলিল,
আর মহান কবি তাঁর দূরদর্শীতা দিয়ে সৃষ্টিকে
করে তোলেন সময়োপযোগী lচলার পথে ছন্দপতন অবশ্যম্ভাবী,
চোরাস্রোত অজান্তেই আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এক
বিষাক্ত খাদের কিনারে, তবু দিনের শেষে মানুষই গাইবে জীবনের জয়গান l দেশ, পৃথিবী জুড়ে
প্রতিমুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা পৈশাচিক আয়োজন,লোভ, ক্ষমতা, আর মিথ্যের সমারোহl মানুষের
ন্যূনতম অধিকার টুকুও প্রতিমুহূর্তে মিশে যাচ্ছে
ধুলোয় l বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তির কৃপায় পৃথিবী আজ গ্লোবাল ভিলেজ,শুধু মানুষে মানুষে
সেতুবন্ধন টুকু বড় ক্ষীণl ক্ষমতার মেরুকরণের ফলে একদল চিরটাকাল ফায়দা লোটে আর অন্যদল
মার খায়,মরে l সভ্যতার শুরু থেকে আজ অব্দি টিকে থাকার এক অসম অদম্য লড়াই l তবু দিনের
শেষে ভেতরঘরে পিদিম জ্বলে l নরম হলুদ আলোয় মণি মুক্ত হয়ে জেগে ওঠে ওইসব গ্লানিমাখা
মুখ,শাশ্বত দীপ্ত প্রাণের স্পন্দন l কবিতাটি
জুড়ে কবি নির্মাণ করেছেন এই জীবনীশক্তির প্রতি
তাঁর অগাধ আস্থার অবয়ব l সময়কাল নির্বিশেষে পৃথিবীর সমস্ত কবিই তাঁদের সৃষ্টির পথে
কখনো না কখনো খুঁজে পেয়েছেন এই অপরূপ আলোর দিশা l আত্মীয়তার এক অমোঘ সুতোর টানে এই
কবিদের অনুভূতিগুলো জড়িত,হয়তো তাই সময়ের ব্যাপ্তিজুড়ে বিভিন্নজনের ভিন্ন ভিন্ন লেখায়
বেজে উঠেছে সমাপতনের এক আশ্চর্য সুর l
"কিন্তু যে রাত্রির গায়ে শিশুর ঘুমের
নিশ্বাস লাগে সে রাত্রি সুন্দর, সুন্দরতম l আমাদের বিদায় হোক যতই বেদনার, অনুশোচনা
নেই l রাত্রির আকাশে দাঁড়িয়ে আছেন কালপুরুষ "(প্রিজনভ্যান এবং কালপুরুষ - কবি
অজিত বাইরী )
এও তো সেই পরম অনুভূতি যা অনায়াসে খুঁজে
পাই বীরেন্দ্রবাবুর কবিতার শেষ চার পংতি
তে l আসলে শত দাবানলের পরেও মহাসমারোহে
আরম্ভ হয় বৃক্ষরোপন উৎসব l প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির তুল্যমূল্য হিসেবের খাতা জুড়ে কাপাস
তুলোর মতো ভেসে বেড়ায় ভালোবাসার আঘ্রাণ l
"বরং মানুষ সমস্ত যন্ত্রনা নিয়ে তার চোখে উজ্জ্বল"(কবিতা
-মানিক বন্দোপাধ্যায়, কবি -বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
এক কুয়াশামলিন সময়ে পথ হেঁটে চলেছে মানুষ,অন্তহীন ভোগবাদ, কুয়াশাঘেরা বিভ্রম সরীসৃপের মতো হিসহিসে
আবেশে পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলছে শ্বাসনালী, দম আটকে আসছে,দেওয়ালে পিঠ ঠেকছে, আখের গুছিয়ে
নেওয়ার নিষ্ঠুর খেলায় ক্রমশ একা আরও একা হয়ে যাচ্ছে তারা l এই ক্ষয়টুকুই তো নিয়তি হতে
পারেনা l অতএব "ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে,
প্রাণ জাগছে "l
রাত্রির অন্ধকার টুকু গায়ে জড়িয়ে জেগে ওঠে
কুসুমরঙা ভোর l সেই ভোরের স্তবগানের রেশ রেখেই উচ্চারিত হয় অমোঘ সত্য
"কারও সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।
"
আলো আঁধারে ভরা এই জগৎ,সখ্য ,প্রেম, মাথার ওপর সুনির্মল আকাশ, পায়ে
লেগে থাকা মাটি,নারী পুরুষের পারস্পরিক মৌতাত, হৃদয় কে সিক্ত করে,সময়ের দেওয়া ক্ষত
সারিয়ে তোলার এক মায়াময় প্রলেপ বুলিয়ে দেয় জীবনব্যাপী lএ কবিতার পাকদন্ডী জুড়ে হাজার
না এর মাঝে জেগে রয়েছে সেই চিরকালিন আশার চর
"মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে
যায়;”(জীবনানন্দ দাশ)
No comments:
Post a Comment