কবি শঙ্খ ঘোষ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বলেছেন "বাংলার সবচেয়ে
প্রতিবাদী কবি"।তার "উদ্বাস্তু ","রুটি
দাও","মুন্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে","পৃথিবী
ঘুরছে" পড়লে বোঝা যায় কেন তিনি এমনটি বলেছিলেন।কিন্তু এমন একটি মানুষ,যিনি
নিজে মুখেই কবি লোথার লুৎসে ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে
বলেছেন,"এখন,এই যে কবিতা লেখার একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়-একটা ছটফটানি-সেটা
নিশ্চয়ই আমার আছে",সেইরকম একটি মানুষ কী কখনো কোনও স্নিগ্ধ একাকিত্ব ভরা অবচেতনের
কবিতা লিখতে পারতেন?এই অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েছিলাম।পথে পেলাম এই পঙক্তি গুলো।
"তুমি চলে গেছ হাজার যোজন দূরে
দক্ষিণে,পশ্চিমে!
আমি বসে আছি উত্তরে চিলঘরে;
আলো নেই,তবু হৃদয় আমার ভরে গেছে কুঙ্কুমে।"
কাকতালীয়ভাবেই এই কবিতার নাম "অবচেতনী"।১৯৫২ সালে রচিত।"শেষ
কবিতা,রাণুর জন্য " কাব্যসংগ্রহের অন্তর্গত।যে কবি মাত্র দুবছর বাদে
লিখবেন,"শহরে এখন সন্ধ্যা নেমেছে,তৃষিতের কথকতা.../ফ্যান দাও বলে কারা কাঁদে
রাস্তায় ",তিনি কীভাবে লিখলেন এই লাইনগুলি?"হৃদয় আমার আবিরে রেঙেছে,আলতা
পরেছে পায়।"বিস্ময়কর লাগলেও পড়তে ভালো লাগে বারবার।এই অবচেতনের ভাষাই তো
কবিকে প্রতিবাদী করে তুলেছিল।তার কাঙ্খিত দেউলে যখন তিনি একদল মানুষকে মোচ্ছব করতে
দেখলেন,তখনই তো বিস্ফোরণ ঘটে গেল!
তবু বলবো
"অবচেতনী" কবিতায় কবি কী নিবীড় সারল্যে খুলে দিয়েছেন তাঁর নিজস্ব
অবচেতনের চাবিকাঠি ।কবি লিখছেন,
"যদিও সময় কালো চোখে কুঁজো-পিঠে পথ হেঁটে যায়
বিরহের ভারি অসহ্য বোঝা বয়ে...
তবু বসে আছি ছোট চিলঘরে পাখিনির মতো হৃদয়কে বুকে লয়ে।"
এই লাইন পড়তে পড়তে আমার কেন মনে হল এই অসহায়তা কবির একার নয়?কেন দৌড়ে চলেছি?কেন
ফুরায় না রাস্তা?কিসের সন্ধানে?নিশ্চয়তা না নির্বাণ,কোনটা বেশি কাঙ্খিত?সাম্যবাদ
কী তাহলে শুধুই মিথ!পুঁথিপত্রে তুলে রাখা উদ্ধৃতিসংগ্রহ!আর সাম্যবাদী নেতারা শুধুই
চৌমাথায় সাজিয়ে রাখা আবক্ষমূর্তি?ভাবতে ভাবতেই মনে হয় এই "ছোট চিলঘরে"
তো আমিও বন্দিনী।পাখিনির মতোই।কখন নিয়তি আর শোষক তুলে নেবে আমাকে তা শুধুই সময়
জানে।কিন্তু তুলে নেবেই।এ অবশ্যম্ভাবী ।তাহলে পথ?কবির কী পথ হয়?প্রাবন্ধিক সুব্রত
গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে ভারি সুন্দর লিখেছেন,"শুধুই কি রাস্তা হাঁটা?অর্ধেক
জীবন তো তার পায়ের নীচে কোনও মাটিই থাকে না।তাহলে কীরকম রাস্তা একজন মানুষের?একজন
কবির?"
কবিতার শেষ স্তবক
এইরকম-
হৃদয় আমার ব্রাউন রঙের হাঁসিনির মতো ঋতুর হাওয়ায় চড়ে
আজ এতকাল পরে
উড়ে এসে দেখা বসেছে আমার বুকের ভিতর মাথা রেখে,
কী জানি কী তার হয়েছে অসুখ পান্ডুরুগির মতন আমাকে দেখে?
হয়তো আবার এতকাল পরে ব্রাউনরঙের ব্লাউজটি দেবে ছুঁড়ে,
এমন একদা দুহাতে তুমিই ছিঁড়ে দিয়েছিলে ফেলে
শরীরের সব,কাঁচুলি ও সায়া,চেতনার চেয়ে জ্বরে।....
ভুল করে তাই আজও গান গাই,'তবে কি তুমিই,তবে কি তুমিই এলে?'
কে জানতো প্রতিবাদী কবির অবচেতনে এতো রোম্যান্টিকতা লুকিয়ে ছিল!ঠিক যেন
শুশ্রূষার মতো।এও তো কম বিস্ময়কর নয়!হয়তো এই সূত্র মেনেই মাও সে তুঙ কবিতা লিখতে
পারতেন,হিটলার লিখতে পারতেন "মে কম্ফ"।কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বলছেন,"আমি মনে করি যে সমাজে যদি,এমন কখনও এমন অবস্থা আসে যে প্রতিটি মানুষ
ভালো,যা আনন্দের তা গ্রহণ করতে পারবে তাহলে সবাই যে মায়াকভস্কি পড়বে তার তো কোনো
মানে নেই।তখন হয়তো এমন কবির কবিতা আমরা আরও বেশি পড়ব যে কবি হয়তো স্বপ্নের জগতে
আমাদের নিয়ে যেতে পারে,কিংবা অন্য কোনো গভীর অনুভবের..."।"অবচেতনী"
তেমনই এক অবগাহনের কবিতা যেখানে একবার ডুব দিলে আর উঠতেই ইচ্ছে করে না।কবিতারসে
মাদকাসক্তি হয়ে যায় ।
ভাবতে আশ্চর্য
লাগে,এই কবির বেশির ভাগ কবিতায় এমন আন্তরিক স্পর্শ পাওয়া কঠিন।আরও একটি কবিতা যেমন
অনেকটা কাছাকাছি।যদিও তার রচনাকাল প্রায় বাইশবছর পর।কবিতার নাম "বন্ধুর
হাত"।"স্পর্শ করলে পুনর্জন্ম হতে পারে/কিন্তু মাঝখানে/বাতাসের
শূন্যতা,চোখের জল ঝরে/যেন শীতের হলুদ পাতা।"কেন এই লাইনগুলো মনে
এল?"অসুখ পান্ডুরুগি" শীতের হলুদপাতার মতো অবচেতনের মতো ধরা দিল
কি?"হৃদয় আমার ব্রাউন রঙের হাঁসিনির মতো" পড়লে মনে হয় এই শব্দবন্ধ
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ বুঝি লিখতে পারতো না।বারেবারে ব্রাউন রঙ
কেন?সে কি সন্ধ্যাকাশের রঙ,নাকি মাটির,না জমে যাওয়া রক্তের!অবচেতনী একধরনের খননের
কবিতা।"চিলঘরে পাখিনি" শুধুই কাতর বিরহচেতনা নয়,বরং বন্দী
বিদ্রোহীসত্তা।আলতা সেখানে শুধুই বিপ্লব।তবু অবচেতনীর অবচেতনে এই কবির প্রেমিক
রোম্যান্টিক অবচেতন লুকিয়ে আছে।হয়তো এই কারণেই কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমার
কাছে শুধুই প্রতিবাদের কবি নন।বরং একজন অনুভূতিপ্রবণ শিল্পী।
No comments:
Post a Comment