“এক অদ্ভুত মাটির উপর
আমরা দাঁড়িয়ে আছি ;
অর্থাৎ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য
প্রাণপণ চেষ্টা করছি
এ মাটির গর্ভে কী আছে
আজও আমাদের জানা নেই
যদিও কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায়
এক লক্ষ সাপের গর্জনের চেয়েও
কোন ভয়ঙ্কর পরিণাম,
যা ক্রমেই আসন্ন হচ্ছে |
কিন্তু আমরা এক পা-ও এদিক ওদিক
নড়ছি না ;
যেন স্থির দাঁড়িয়ে থাকাই
আমাদের নিরাপত্তা,
এবং তা সম্ভব | আমরা গির্জার গম্বুজগুলির
এবং স্টক এক্সচেঞ্জের চার দিকের বিরাট
স্তম্ভগুলির দিকে
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে
এক সময় ঈশ্বরের মহিমাকে জানতে পারছি
আর এই কথা ভেবে নিশ্চিন্ত হচ্ছি—
আমাদের স্বদেশ স্বাধীন এবং তার
সীমান্তে
বন্দুকধারী প্রহরীরা প্রত্যহ টহল
দিচ্ছে |
যদিও পায়ের নিচে মাটি এখন অগ্নিগর্ভ ;
যদিও আমাদের মাথার উপর আকাশ বলতে কিছুই
নেই |”
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
মাত্র একটি কবিতা নিয়েই লিখতে হবে, এরকমই কড়ার সম্পাদকের। বলা হয় হাঁড়ির একটা ভাত টিপলেই
নাকি বাকি ভাতেরও চরিত্রের হদিস পাওয়া যায়। সেটা কি কবিতার ক্ষেত্রেও সত্যি? কিন্তু
তা হলে তো কবির কবিতার কোনো বাঁক বদলই থাকার কথা না! সেটা যে কোনো সার্থক কবির ক্ষেত্রেই
খাটে না, সিরিয়াস পাঠক মাত্রই তা জানেন। উলটো দিকে এটাও সত্যি প্রত্যেক কবির নিজের
ভাষা খোঁজার একটা জার্নি থাকে। বিনয় মজুমদারের কবিতার সঙ্গে ঘর করা এক পাঠক কবির অপঠিত
একটি কবিতা পড়েও সেটা শক্তির ভেবে ভুল করবেন না, বরং আন্দাজ করে নেবেন যে সেটা বিনয়েরই
লেখা। এই যে নিজের ভাষা খুঁজে নেওয়া এবং একই সঙ্গে নিজেকে অনবরত ভাঙতে থাকা এই দুইয়ের
এক আপাত অসম্ভব ব্যালেন্সের অপর নাম হল কবিতার পথ চলা।
যাই হোক সম্পাদকের তাড়ায়
বহুদিন বাদে কবির “নির্বাচিত কবিতা” নিয়ে বসা গেল। পাতার পর পাতা যেন আগুনের গোলা।
সটান কিন্তু অতিনাটুকে না। একটা কবিতায় গিয়ে চোখ আটকালো ইংরেজির ব্যবহারে – “A
proletariat has nothing to lose but his chains.”। কবিতার নাম “উলঙ্গের স্বদেশ”। উলঙ্গ
শব্দ থেকে ক্ষণিকের মধ্যে মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত কবিতা – “উলঙ্গ রাজা”। একটু খোঁজ
নিলেই জানা গেল দুটি কবিতা প্রায় সমসাময়িক। “উলঙ্গের স্বদেশ” লেখা ৭ শ্রাবণ ১৩৭৫ আর
নীরেন্দ্রনাথ “উলঙ্গ রাজা” লিখছেন ৩ পৌষ ১৩৭৬। তিনি বীরেন্দ্রনাথের এই কবিতাটি পড়েছিলেন
কিনা জোর দিয়ে বলতে পারব না, কিন্তু পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক
ছিল। উলটো দিকে বীরেন্দ্রনাথ “উলঙ্গ রাজার” প্রশংসা করছেন প্রকাশ্যে এটা জানতে পারছি।
মজার কথা হল পরে লেখা “রাজা তোর কাপড় কোথায়”-এ গতানুগতিক রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে আক্রমণ।
কিন্তু “উলঙ্গের স্বদেশে” জাতি-রাষ্ট্রের ধামাধরা দেশের ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে,
চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে গির্জা এবং ক্যাপিটালকে।
নৈরাজ্যবাদের (Anarchy, Chaos নয় কিন্তু!) পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন পাঠক?
বর্তমানের সীমান্ত আর
সৈনিক নির্ভর দেশের যে একমাত্রিক ধারণা গেলানো হচ্ছে, অর্ধশতাব্দী আগে লেখা এই কবিতা
যেন তারই সমসাময়িক হয়ে উঠছে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মন্থনজাত এলিয়েনেশন আমাদের মধ্যে
জন্ম দিচ্ছে আদিম ভয়। সেই ভয়কে বাস্তব রূপ দিতে তুলে ধরা হচ্ছে অপরের (The Other) ধারণা।
আর সেই ভয় থেকে মুক্তির উপায় রাষ্ট্র নায়কের ৫৬ ইঞ্চির ছাতি আর সেনাবাহিনীর বন্দুক।
“আমাদের স্বদেশ স্বাধীন এবং তার সীমান্তে
বন্দুকধারী প্রহরীরা প্রত্যহ টহল দিচ্ছে”
এতকিছু সত্বেও এই কবিতাটি
কেবল মাত্র এক বলিষ্ঠ লেখা হয়েই থাকত যদি না শেষ লাইনে এসে কবি আকাশকে অস্বীকার করতেন।
"ন্যাংটার নেই বাটপারের ভয়"। উলঙ্গেরও কোনো ভয় থাকতে নেই, ভক্তিও না। তার
দেশ নেই, ধর্ম নেই, ভোট থাকলেও ভাষা নেই, তাই কোনো ছদ্ম নিরাপত্তা বোধ নেই। আকাশ অভাগার
শেষ আশ্রয়, কিন্তু ওই উলঙ্গের দেশে তাও নেই।
“যদিও পায়ের নিচে মাটি এখন অগ্নিগর্ভ ;
যদিও আমাদের মাথার উপর আকাশ বলতে কিছুই
নেই |”
এই ক্ষুদ্র আলোচনার প্রথম
দিকে নীরেন্দ্রনাথ এবং বীরেন্দ্রনাথের "উলঙ্গ" নিয়ে বলছিলাম। বাংলা কবিতার
আবহমান ধারাকেই নির্দেশ করে তা। এবার শেষ করব এই মিথ্যে আকাশের ধারণা কীভাবে ভেসে আসছে
বর্তমানের এক অখ্যাতের কিছু লাইনে।
“শূন্যতা কে ধরতে হলে
আকাশ থাকলে চলে না,
কারণ “আকাশ” বলে প্রকৃতপক্ষে
কিছু নেই।
তাই ছাদটাকে ঠুকে ঠুকে
ভেঙে ফেলা ছাড়া
কবিতার কাছে তৃতীয় কোনো
বিকল্প নেই!” (নির্বিকল্প /এই অধম)
[বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ:
আমি শ্রীরামের নামে শপথ করিয়া কহিতেছি বীরেন্দ্রের "উলঙ্গের স্বদেশ" হইতে
টুকি নাই। এর পরেও বিদ্বজনে খাপ বসাইলে বান্দা নাচার।]
No comments:
Post a Comment