Wednesday, August 28, 2019

বুবুন চট্টোপাধ্যায়: আজও তিনি প্রাসঙ্গিক







আমার কবিতা-যাপনের শুরুটা অনেকটাই কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আলো-ছায়ায় কেটেছে। আধুনিক কবিতা বলতে সেই আট এবং নয়ের দশক জুড়ে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন দত্ত ছাড়াও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় মগ্ন হয়ে থাকতাম। তার একমাত্র কারণ তাঁর কবিতা আমার অর্জুন গাছের মতো ঋজু মনে হতো। এখনো সেই বোধ থেকে সরে আসিনি একটুও।  বরঞ্চ যত বয়েস বাড়ছে, যত তাঁর   কবিতার অন্দরে ঢোকার হদিস মিলছে ততই মনে  হচ্ছে কবিকে ক্রান্তদর্শী হতে হয়। সেই কবিদের কবিতা ই বেঁচে থাকে। যেমন- বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেইসব জীবিত কবিতা নিয়ে এখনো আমাদের ঘর-দোর, উঠোন -বাগান আলো হয়ে থাকে।
আধুনিক কবিতার সাং সর্গে যখন আসছি তখন প্রয়াত কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রতি মাসের শেষ শনিবার একটি কবিতা পাঠের আসর বসতো নিয়মিত। কবির পুত্র - কন্যাদের আতিথেয়তায়। সেখানে আমরা কয়েকজন বন্ধু যেতাম কবিতা  শুনতে। সব্যসাচী দেব, অমিতাভ গুপ্ত কে ওখানেই শোনা। ওখানেই শোনা প্রথম প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে। এই অনাবশ্যক কথাগুলো বলার কারণ আমি এখন যে কবির কবিতা নিয়ে আমার মতো করে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো আমার আহ্লাদ, আমার শ্লাঘা সেই কবির ঘর - গেরোস্থালি আমি চিনি। আমার প্রথম যৌবনের কবিতা যাপনের সঙ্গে তিনি আষ্টেপৃষ্টে জড়িত।     

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় " সাগ্নিক " কবিতাটি লিখেছিলেন    ১৯৭৪ সালের ৩০ শে এপ্রিল। কবিতার প্রথম স্তবক, " অস্থির হয়ো না। / শুধু প্রস্তুত হও। সাতের দশক আমাদের বাংলা নকশাল আন্দোলনের আঁচে উত্তাল। কবি - শিল্পী তিনিই যাকে  সর্বদা সমসাময়িক অরাজক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে এসেছেন। কতিপয় রাস্ট্র নেতাদের অভিসন্ধি বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কবিও সেই সততার বাইরে ছিলেন না। বরঞ্চ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ভূবণ প্রতি মুহূর্তে  জারিত হয়েছে   সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে। এই কবিতাটি যখন লেখা হয় সাতের দশকের ওই টালমাটাল সময়ের প্রেক্ষিতে।  কলেজ - বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র- ছাত্রীরা সেদিন কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। সেই আগুনে আন্দোলনের তাপ নিয়েই তিনি লিখেছিলেন এমন একটি কবিতা।
পরের স্তবকে তিনি বলছেন " এখন কান আর চোখ খোলা রেখে / অনেক কিছু দেখে যাওয়ার সময়। / এ সময় স্থির থাকতে না পারার মানেই হল, / আগুনে ঝাঁপ দেওয়া।  / তোমার কাজ আগুনকে ভালবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়। /  আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা।  / অস্থির হয়ো না ;/ শুধু প্রস্তুত হও। " ঋজু, সরল, জলের মতো কবিতা অথচ মন্ত্রের মতো গভীর। শঙ্ক্ষের মতো দৃঢ়। কী অনায়াসে তিনি ধরে ফেলেছেন সেইসময়ের প্রতিবাদী যুব সমাজের অন্তস্থলকে। তিনি পরতে, পরতে অনুভব করেছেন প্রত্যেকেই রাস্ট্রের ধাষ্টামোর বিরুদ্ধে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সেই আগুনে ঝাঁপ দিলে পুড়ে মরাই সার হবে। বরং হৃদয়ের আগুন জ্বালিয়ে রেখে  আগামী দিনের আরো মহৎ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কবির এই কতদিনের কথা আজকের সমাজ - শোষনের প্রেক্ষিতে কী অসামান্য সত্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে কী?    না রাখে না। কারণ তাঁর দীর্ঘ কবিতা যাপন থেকে আমরা বারবার দেখেছি ব্যক্তি যন্ত্রণার থেকে সমাজ- যন্ত্রণা, সম্মিলিত মানুষের অসহায়তার কথা উঠে এসেছে। তাদের ভাতের কান্না প্রতিনিয়ত তাঁকে বিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সুবিধাবাদী, মধ্যবিত্ত মানুষের দ্বিচারণ তাঁকে সারাজীবনে ক্লিষ্ট করেছে। তাঁর দীর্ঘ কবিতা রচনার মধ্যে পাঠক সেইভাবে কোনো ব্যক্তিপ্রেমের স্বর খুঁজে পান না। তাঁর মনন, তাঁর দর্শন আত্মপ্রেম এর সীমায়িত গন্ডি ছাড়িয়ে প্রতিদিনের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য দগ্ধ হয়েছে। যেকোনো মহৎ কবি, মহৎ শিল্পীর এটাই লক্ষ্মণ। যে কবি - শিল্পীকে সমসাময়িক সমাজ স্পর্শ করে না, যে কবি রাস্ট্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেন না তাঁর শিল্প নিয়েও পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে। সেই প্রশ্নের অবকাশ রাখেননি তিনি। এই কারণেই বোধ করি তিনি এবং তাঁর কবিতা এখনো এতো প্রাসঙ্গিক।                                                            
                                     
    

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

সে চেয়েছিলো একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে। তার তো একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে? ...

পাঠকের পছন্দ