Wednesday, August 28, 2019

সুদেষ্ণা ঘোষ-এর কবিতা






দিনগুলি রাতগুলি

আমাদের বাড়ির পাশে একটা সারাবছর ঘুমিয়ে থাকা পলাশ গাছ ছিল
হঠাৎ একদিন সারা পাতায় আগুনের আভা চলকে যেত
অনুমান করা যেত আর ক’দিন বাদেই এবার মস্ত বড় আতঙ্কিত চাঁদ উঠবে
চাঁদকে চালচিত্র করে বসে থাকবে সিলুয়েটে দু’টো নিস্তব্ধ কাক
এসব দেখে-দেখেই একদিন ফুরিয়ে যেত সঞ্চয় বা বলতে পার সময়
রাস্তাটি বেশিরভাগ সময়েই শুনশান, কদাচিৎ একজন-দু’জন মানুষ
বেশিরভাগ সময়েই ধূসর মুহূর্তরা জমাট হয়ে কেলাস বেঁধে থাকত হাওয়ায়।
এই পর্যন্ত শুনে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে কিছুটা এই যে
আমার ছোটবেলাটা খুব স্বচ্ছতোয়া ছিল না...

বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে অবশ্য মেনে নিচ্ছিলাম সব কিছু
ছায়াদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতাম
বিকেলের মরে আসা আলোর সঙ্গে ভাগ করতাম বেহায়া বিস্কুট
ঝরা পাতাদের পেরিয়ে যেতে-যেতে মনে হত এভাবে দূরত্ব পেরনো কোনও কষ্টের ব্যাপারই না।
সেসব দিনে সবসময় রাস্তার ধারে একটা রিকশা হেলে থাকত একপাশে
সেই মরণোনম্মুখ ফিকে আলো, কোথাও না যেতে চাওয়া রিকশা আর সারাবছর ঘুমিয়ে থাকা পলাশগাছ এরা আমার ভিতর একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দিত, এখন বুঝি
তখন বুঝিনি, কিন্তু তখনও ফোটা পলাশের চেয়ে আমার ওই নিষ্পুষ্পক গাছটিকেই বেশি কাছের মনে হত এটা সত্যি।

যেসব বিকেলে এসব আমি আমি বারান্দায় বসে ভাবতাম, সে আমলে জেটপ্লেন আকাশে অনেকখানি স্মৃতি ফেলে যেত
তারপর তো দিন পালটে যাচ্ছিল
মানে দিন তার ডানা ছড়াচ্ছিল আর রাতগুলো ঢেকে যাচ্ছিল
আসলে আমি স্পষ্ট বলতে চাইছি আলোই গ্রাস করে নিচ্ছিল সবকিছু
আর অন্য কোথাও অন্য কোনও দেশে চলে যেতে-যেতে বাসের জানলা দিয়ে ঘুমের মধ্যে দিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম পলাশ গাছ ঘুমিয়ে আছে
রিকশাটা পড়েই আছে একপাশে
ছায়ারা অধোবদনে মিশে যাচ্ছে আলোর শরীরে
আলো মরে যাচ্ছে একইরকম নিঃসারে...

ক্রমশ জানছিলাম বিশ্বাসরা প্রত্যেকেই সরু সুতোর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ট্র্যাপিজ় খেলোয়াড়
তাই তার পা পিছলানোর মুহূর্ত যাতে না দেখতে হয়
তাই একদিন চোখ বন্ধ করে ফেলেছি, নিশ্চিন্তেই আছি
নান্দনিক মুহূর্তদের সুমোহিত ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখি
সুশোভন শ্লীল পরদা টানটান টাঙানো জীবনের চারধারে
শুধু ‘গোপনীয়’ শব্দটিকে আলাদা সম্ভ্রমের চোখে দেখি

মাঝেমাঝে প্লেন গেলে শুধু অস্থির লাগে
অদৃশ্য সেই অন্তহীন দাগগুলোকে খুঁজি
টের পাই ঈষৎ চলকে যাচ্ছে ঘুমন্ত পলাশ গাছ,
হেলে থাকা একা রিকশা
আর...না, কেউ না।
সত্যি।

অসহায়তা

কোনও-কোনওদিন গুছিয়ে তুলতে চাই
ঝড় আসুক,  মুখরিত খাঁচা না-ই বা দুলুক।
তবুও হাত ফসকে সাবেকি ছন্দ ভেঙে যায়।
মেঘ না থাকলেও তুমুল হাওয়া বইতে থাকে।
রোদেলা আলোয় দূরের পালক ভেসে বেড়ায়।

এতদিনে এটুকু বুঝেছি গোলের শেষ বিন্দুতে পৌঁছনোমাত্রই
রেখাটি এঁকেবেঁকে সোজা হতে থাকবে।
বিচার বা ক্রোধের পরোয়া না করেই।
এই অবাধ্যতার শাস্তি কী হবে ভাবতে গেলেই দেখি
আকাশ-ভাঙা জানলায় নিরুত্তেজ পালক ভেসে যায়।

কিন্তু যে রেখাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে সমর্পণে
তাদের জন্য স্মৃতির গাঢ় ঘুমে হাত থেকে পড়ে যাবেই পেনসিল
সেই আওয়াজ নিকনো উঠোনে মৃদু কষ্ট রেখে যায়।
অস্পষ্ট গানের ভিতর সারা রাত
সারা রাতই জেনো, অসহায় পালক ভেসে যায়।





No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

সে চেয়েছিলো একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে। তার তো একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে? ...

পাঠকের পছন্দ