একটি কবিতা বহুমাত্রিক হলে, রহস্যাবৃত হলে সেই লেখাটির কাছে বারবার ফিরে
যাওয়া যায়। কবিতার তন্নিষ্ঠ পাঠক চান, পঠিত প্রতিটি পঙ্ক্তিকে চেটেপুটে খেতে,
সমস্ত রস নিংড়ে নিয়ে উপভোগ করতে। পরতের-পর-পরত পেরিয়ে যেতে-যেতে যে-কবিতা প্রতি
মুহূর্তে বিষ্ময়াবিষ্ট করে, অপ্রত্যাশিতের সামনে এনে দাঁড় করায়, সেই লেখাটিকেই
আঁকড়ে ধরেন পাঠক। সেই কবির কাব্যগ্রন্থটি মাথার বালিশের পাশে রেখে ঘুমোন।
বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের অনেক কবিতাই লোকের মুখে মুখে ফেরে, বেশ কিছু কবিতার এক-একটি পঙ্ক্তি,
স্লোগানধর্মীতার কারণে, তুমুল জনপ্রিয়। তবে, সেসব কবিতা বা পঙ্ক্তির অনুসঙ্গ মূলত রাজনৈতিক। বাংলা
কবিতার নিয়মিত পাঠক নন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই হয়তো জানেন না, আধুনিক বাংলা কবিতার
অন্যতম এই কবি প্রেম, প্রকৃতি নিয়েও কাব্য রচনা করেছেন বিস্তর।
এই নিবন্ধটি লেখার
প্রস্তুতিপর্বে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কিছু কবিতা, অনেকদিন পর, ফের পড়তে
হল। কোনও কবির লেখা পড়া মানে, তাঁর সঙ্গে একধরনের আলাপচারিতাই। বীরেন্দ্র’র কবিতা শুধু প্রতিবাদী
চেতনাকেই জাগ্রত করে না, তাঁর একাধিক রচনা লোকায়ত, চিরায়ত, শাশ্বত’র প্রগাঢ়
উচ্চারণও।
‘অনুভব’ কবিতাটি আমার পছন্দের অন্য কারণে। এই লেখাটি যেন বর্তমান সময়ের
কথা বলে। যে-সময় বন্ধ্যা। দিশাহীন মানুষের সামনে কোনও আশার আলো নেই, কোনও
পরিত্রাতা নেই, সুগভীর আদর্শ নেই। যে বিশ্ব
হানাহানির, মানুষে মানুষে বিভেদসৃষ্টিকারীর...এই কবিতা যেন তারই মর্মন্তুদ আবহ
সৃষ্টি করে চলে। যে সমাজে ব্যক্তিমানুষ ক্রমশই একা হয়ে পড়েন, শ্মশানের নিস্তব্ধতা
গ্রাস করে তাঁর সত্তা...এ লেখা বুঝি সেই মানুষের দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভয়ার্ত
উচ্চারণ। লেখাটি বারংবার পড়ি, পড়তে হয়, কবি পড়িয়ে নেন।
তাহলে সকলি স্তব্ধ! পৃথিবী, আকাশ, নক্ষত্রের
বিছানায় পাশ ফেরা, বাদুড়ের ডানার চিত্কার,
জানালায় মুখ রেখে ফেরারী হাওয়ার দু’দণ্ডের
স্রপ্ন দেখা, শিউলির শিশিরে বিছানা পাতবার
আয়োজন, সব স্তব্ধ! এমন কি শ্মশানে শিবার
আর কোনো মুখ নেই ; কোনো শকুনের চোখ নেই!
বিছানায় পাশ ফেরা, বাদুড়ের ডানার চিত্কার,
জানালায় মুখ রেখে ফেরারী হাওয়ার দু’দণ্ডের
স্রপ্ন দেখা, শিউলির শিশিরে বিছানা পাতবার
আয়োজন, সব স্তব্ধ! এমন কি শ্মশানে শিবার
আর কোনো মুখ নেই ; কোনো শকুনের চোখ নেই!
কবিতাটি যেভাবে শুরু হয়েছে
তাতে মনে হয়, কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন কবি। যে-ঘটনা বা
পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর যে, সব কিছু স্তব্ধ হয়ে আছে। যা-কিছু সুচারু, নৈসর্গিক, মানবিক,
শরীরবৃত্তীয় ও নিরপেক্ষ…সব নিশ্চল, জড়বৎ, প্রস্তরীভূত এই ত্রিভুবনে।
কবিতাটিতে পাঁচ-পাঁচটি
প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়সূচক চিহ্ন তিনটি। অর্থাৎ, কবি এখানে বিভ্রান্ত।
যে ‘কনফিউশন’-এর কথা আমরা শুনতে পাই ঋত্বিককুমার ঘটক পরিচালিত যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-র প্রোটাগনিস্ট
নীলকণ্ঠ বাগচীর সংলাপে, এ যেন তারই সমউচ্চারণ। যেন কবি বলছেন, ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, আমিও পুড়ছি।
তবে কার শবাধার সময়ের
নিজের ঘরেই
পরিত্যক্ত পড়ে আছে রক্তহীন বিবর্ণ আত্মার
বিলুপ্তির মতো এক শূন্য অনুভবের চাদরে
আপাদ-মস্তক ঢাকা ? তবে কার শব যাত্রায়
সময় হল না এই পরিত্যক্ত প্রাণের প্রান্তরে ?
নাকি হৃদয়েরই মৃত্যু এইখানে ? তোমার আমার
সকলি হয়েছে বলা ? নক্ষত্রের, পাখির, ফুলের
তাই আর কথা নেই, তাই আজ ক্লান্ত কুকুরের
প্রেমিকের মতো আর মন নেই ? ফণীমনসার
বুক তাই শূন্য, তাই ত্রিভূবনে সকলি অসার?
পরিত্যক্ত পড়ে আছে রক্তহীন বিবর্ণ আত্মার
বিলুপ্তির মতো এক শূন্য অনুভবের চাদরে
আপাদ-মস্তক ঢাকা ? তবে কার শব যাত্রায়
সময় হল না এই পরিত্যক্ত প্রাণের প্রান্তরে ?
নাকি হৃদয়েরই মৃত্যু এইখানে ? তোমার আমার
সকলি হয়েছে বলা ? নক্ষত্রের, পাখির, ফুলের
তাই আর কথা নেই, তাই আজ ক্লান্ত কুকুরের
প্রেমিকের মতো আর মন নেই ? ফণীমনসার
বুক তাই শূন্য, তাই ত্রিভূবনে সকলি অসার?
‘এক শূন্য অনুভবের চাদরে আপাদ-মস্তক ঢাকা’ মানবসভ্যতা কবিকে দগ্ধ
করেছে, কবি কষ্ট পেয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তবে কি এই কবিতা কেবলই বিভ্রান্তির,
নৈরাশ্যের কবিতা? তবে কি সুড়ঙ্গের শেষে কোনও আলোর প্রতিশ্রুতি নেই? মনে রাখতে হবে,
এই কবির নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবিতায় দু’বার ব্যবহৃত
হয়েছে ‘স্তব্ধ’ শব্দটি। প্রথম বার শব্দটির আগে বসেছে ‘সকলি’, দ্বিতীয় বার ‘সব’। এবার কবিতাটির আবহে কান পাতুন। এক দিগন্তপ্রসারী নৈঃশব্দ কানে বাজবে।
যে-স্তব্ধতায় বুক কেঁপে ওঠে। এ যেন প্রবল ঝড়ের বার্তাবাহী এক নিরবিচ্ছিন্ন
স্তব্ধতা। সেই ঝড়ের নাম হয়তো-বা ‘বিপ্লব’ !
আলোচ্য কবিতাটির একাধিক ব্যাখ্যা, পাঠ-প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। সেটাই
স্বাভাবিক। আমার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে নাও পারেন পাঠক। কিন্তু, কবিতা হল নিভৃত
পাঠের, কাব্যের গভীরে একাকী ডুব দেওয়া। আমি সেই একলা ডুবুরি , এই কবিতাটির থেকে
অর্জিত অনুভূতিটুকু শেয়ার করলাম...এর অতিরিক্ত কিছু নয়।
No comments:
Post a Comment