Wednesday, August 28, 2019

অনিকেত রায়: নশ্বরতার প্রতীক: কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়







আন্দ্রেই তারকোভস্কি পরিচালিত "Stalker" সিনেমায়, স্টকার চরিত্র অনেক ভাবে মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন জাগরিত করবে। মানুষের উপর কি আর বিশ্বাস করা যায়? ঈশ্বর কে? কেনই বা নশ্বরতার প্রতীক হয়েই স্টকার থেকে গেলেন? শেষ দৃশ্যে স্টকার চরিত্রের কান্না ও অভিযোগ আমাকে বেশ কয়েকটি দিন ভাবিয়ে রেখেছিল। বিশেষ করে বারবার মনে হয়েছে যে এই চরিত্রকে বিচার করার ক্ষমতা হয়ত আমাদের নেই। সেই গভীর চোখ দুটির স্তব্ধতার মধ্যে এক সীমাহীন ধূসরতা লক্ষ্য করা যায়। ঠিক যেমন ঈশ্বর কেঁদেছিলেন নিজের স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে সভ্যতার চেহারা দেখে। মানুষ আর ঈশ্বরকে চায় না। তারা দু দণ্ড সুখের খোঁজে পৃথিবীতে এসে অন্ধকারের নিঃসঙ্গতায় মিশে যায়, তাদের কোনো আশা নেই, আছে শুধু লোভের অহংকার এবং ধর্মের বর্বরতায় অন্ধ হবার লক্ষ্য। এই সমস্তই ছিল অভিযোগ।

সাম্প্রতিক সময় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতায় এরকমই এক ভাবের সন্ধান পেলাম। স্তব্ধতার মধ্যে থেকে হেঁটে যাওয়া এক নাগরিক কখন যেন নিজেই ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। আমাদের দেখিয়ে যান নশ্বরতার চিত্রনাট্যে গড়ে ওঠা সমস্ত বেদনায় ভেসে যাওয়ার এক প্রাকৃতিক জলচ্ছবি। কবিতাটি :

আমার ঈশ্বর নেই

আমার ঈশ্বর নেই ব'লে
সবাই আমাকে উপহাস
ছুঁড়ে দেয়। অথচ আমি যে
ঈশ্বর বানাই, বারোমাস
তাই তারা কিনে নেয় ঘরে।
নিরীশ্বর মাথার উপর
আমি খুঁজি আকাশের রঙ
শুনি সপ্তর্ষির মৃদুস্বর

কুয়াশায়। স্বর্গীয় বাতাসা
মুখে ক'রে কীর্তনের দল
ঘরে ফেরে। ভক্তেরা ঘুমায়।
তাদের ঈশ্বর অন্তর্জল
পদ্ম হয়ে স্বপ্নের ভিতর 
হাওয়া দেন। . . . নিষিদ্ধ আঁধারে
আমি খুঁজি আমার পাথর
মেঘে, বজ্রে, শূন্যে, তেপান্তরে।
{বেঁচে থাকার কবিতা, ১৯৭৮}

আলোচ্য কবিতায় এক যাত্রার কথা উঠে আসে। নির্বাণের দিকে এগিয়ে চলার যাত্রা। কবি এখানে এক ব্যর্থ পুরুষ সমাজের চোখে। উপহাসের পাত্র তিনি ঠিক ইলিয়টের প্রুফকের মত। তার কোনো মূর্তীয়মান ঈশ্বর নেই, নেই কোনো ধর্মের জটিলতা ও অহংকার। অথচ তিনিই ঈশ্বরের শরীর যত্ন করে তৈরি করেন এবং তা-ই মানুষ নিয়ে যায় সঙ্গে করে নিজেদের ঘরে।
"নিরীশ্বর মাথার উপর/ আমি খুঁজি আকাশের রঙ/ শুনি সপ্তর্ষির মৃদুস্বর/ কুয়াশায়।"

এই পংক্তিটি কেন উল্লেখ করলাম তার এক বিশেষ কারণ আছে। এই পংক্তিতে কবির মূল ভাব লক্ষ্য করা যায়। ক্রমাগত তিনি স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের রূপ নিচ্ছেন। চারিদিকে মানুষ ঘুমোচ্ছে। কুমার সিদ্ধার্থের পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি সব ছেড়ে এগিয়ে চলেছেন, সর্বস্ব উজাড় করে, এক আকাশছোঁয়া নির্জনতার ঘরে। কবির এই অনুভবের স্পর্শ ধীর গতিতে এগিয়ে চলে। তিনি সপ্তর্ষির মৃদুস্বর শুনতে পান কুয়াশার আলোকচিত্রে। এখানে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলমে আধ্যাত্মিকতা আবারও মর্ডানিজমের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। অবক্ষয়ের তীব্র স্রোতের ধারায় তিনি বিপরীতে এগিয়ে যেতে যেতে বাস্তবতার এক কঠিন চেহারার সঙ্গে পরিচয় করান। কবি বলছেন : 
"স্বর্গীয় বাতাসা/ মুখে করে কীর্তনের দল ঘরে ফেরে/ ভক্তেরা ঘুমায়/ তাদের ঈশ্বর অন্তর্জল পদ্ম হয়ে স্বপ্নের ভিতর হাওয়া দেন।"
এই কথাগুলো কি আধুনিকতার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ নয়? নয় কি স্টকারের কান্নার দু-এক ফোঁটা? আমরা আসলে কিছুতেই চিনে উঠতে পারিনি ঈশ্বর এবং কবিদের আক্ষরিক স্থান। কবি তাই হয়ে ওঠেন পুরোহীত। খালি পায়ে এই শহরের গলিদের অন্ধকারে তিনি মাথা নত করেন। খুঁজে চলেন তার ঈশ্বর কুড়িয়ে পাওয়া "পাথর, মেঘে, বজ্রে, শূন্যে, তেপান্তরে।"

এই কবিতার সাথে আজকের বিখ্যাত স্লোভেনিয়ান দার্শনিক  স্লাভই জিজেকের একটি ধারণার তুলনা করা যায়। খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার নবম ঘন্টায় তিনি বলে ওঠেন, "Eloi Eloi lama sabachthani?" যার অনুবাদ করলে হয়, "Father, why have you forsaken me?" জিজেকের মতে এই ছোট্ট করুণ মূহুর্তে ঈশ্বরের মূর্ত রূপ যিশু খ্রিস্ট হয়ে ওঠেন নাস্তিক, অল্প সময়ের জন্য হলেও। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি এরূপ অসাবধানী নাস্তিকতা লক্ষ্য করা যায়, পংক্তিগুলির মধ্যে। যা হয়তো কবির অবচেতন মর্ডানিস্ট মনের কিছুটা আবশ্যিক মন্দগ্রাহিতার প্রতিফলন।


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

সে চেয়েছিলো একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে। তার তো একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে? ...

পাঠকের পছন্দ