মানুষটির সাথে পরিচয় “ঈশ্বর আর প্রেমিকের
সংলাপ” কবিতা দিয়ে। আশ্চর্য এক আনন্দ আবিষ্কারে বুঁদ তখন। কবিতার সাথে সখ্যতাও তখন
থেকে শুরু বলা যায়। কবিতা না বুঝেও তার পিছু পিছু ঘুরঘুর করা মানুষ বলতে যাদের বোঝায়
আমি তাদের দলে। কবিতা লিখিয়েরা আমার কাছে বিশেষ একজন মানুষ। আর সেটি যদি হন আবুল হাসান
কিংবা জয় গোস্বামী তবে তো সোনায় সোহাগা। জয় গোস্বামীর সব কবিতা আমি পড়েছি এমন দাবী
করিনা। তবে বেশ কিছু পড়া হয়েছে। সংগ্রহে থাকা কবিতার বইয়ের মধ্যে ওঁর বই-ই সংখ্যায়
বেশি। কবিতা পড়া হলেও তাঁর প্রবন্ধ বা গল্প তেমন পড়া হয়নি। হঠাৎ করেই হাতে এসে যায়
জয় গোস্বামীর গল্পগ্রন্থ “ সংশোধন বা কাটাকুটি”। আর কে পায় আমায়!
জয় গোস্বামীর গল্পেরা তাঁর কবিতার মতোই
পাঠকের ভেতর বাড়িতে সপাটে ঢুকে যাবার ক্ষমতা রাখে। “সংশোধন বা কাটাকুটি” পড়তে পড়তে
পাঠক মন গল্পের মনকাড়া শব্দের ভাঁজ খুলতে খুলতে নানামুখী প্রশ্নে আচ্ছন্ন হয়।
জীবনটা লিখে ফেলা একটা কবিতা কিংবা গল্প
কী? লেখালেখির পরতে পরতে ভুলভ্রান্তি হলে যেভাবে কাটাকুটির মাধ্যমে সংশোধন করে নেয়া
সম্ভব, জীবনের বেলাতে তেমনটা সম্ভব? ভুলভ্রান্তি থেকে বাঁচতে বড়জোর ঘটনার বাইরে একটা
নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে জীবন যাপন হয়ত করা যায়। কিন্তু সেটা হয় পলায়নপর জীবন। কিছুটা আত্মকেন্দ্রিকও
বটে! কিছু মানুষ এমন করে জীবন পার করেন বৈকি! জয় গোস্বামীর “সংশোধন বা কাটাকুটি” বইয়ে
যে চারটি গল্প রয়েছে; তার চরিত্রগুলোর কেউ কেউ তেমন চেষ্টায় হন্য হয়। যেমন “জুরাসিক
পার্ক” গল্পের আতসী। কিন্তু ঘোর সংসারি এবং কতর্ব্যের জালে আটকে থাকা মেয়েটার পক্ষে
সে চেষ্টা কতটা সফল এ গল্প আমাদের সেকথা জানায় না। জানায় কেবল তার দ্রোহটুকু। অন্যদিকে
রঞ্জন বসু, দোলনা, শকুন্তলা মৈত্র অনেক চেষ্টাতেও ঘটনার বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না
যেন। কারণ সংশোধন করে সঠিক শব্দ বসিয়ে কবিতা কিংবা গল্পকে সুন্দর সাজানো গেলেও জীবনকে
তো সেভাবে সাজানো হয়ে ওঠে না অনেক সময়ই। ঘটনাচক্রে হাত ফস্কে খাঁদে নেমে যাওয়া সে জীবনকে
খুব গোপনেই যাপন করতে হয়। তেমন জীবনই যাপন করে যেতে হয় “হাসির কথাই তো হচ্ছিল” গল্পের
রঞ্জন, দোলনা, শকুন্তলাদের।
অন্যদিকে “সংশোধন বা কাটাকুটি” গল্পের
কবি নিজের লেখার সংশোধনে পারঙ্গম হলেও জীবন নামের চিত্রনাট্যে তা প্রয়োগে বার বার পিছিয়ে
যান। কারণ এ তো কোন বোকাট্টা ঘুড়ির জীবন নয়। দোয়েল কিংবা ফড়িংয়ের জীবনও নয়...উড়ে গেলেই
চুকে যাবে! এ মনুষ্য জীবন। এর সুতা ধরে থাকা অদৃশ্য নাট্যকারের পাশাপাশি থাকে আরেক
শ্রেণীর দৃশ্যমান ব্যক্তিসত্ত্বা, যে বা যারা কারণে অকারণে ব্যথা দিতে ওস্তাদ। তোমাকে
বিদ্ধ করাতেই যার আনন্দ অপার। তুমি ভুল, তোমার আচরণ ভুল সে/তারা যা বলে তাই সঠিক। কবি
যাকে বলছেন 'ঘাতক'। এরা মাধব সেন, শিপ্রাদি, ভাইদা, ভালদি, মেজোকাকা,কাকি ছোটকার মত
চেহারা নিয়ে আমাদেরই আশেপাশে আবর্ত হচ্ছে। এবং মাছি যেমন একাগ্রতায় ক্ষতস্হান খুঁজে
ফিরে; ঠিক সেভাবে অন্যের কোথায় দুর্বলতা রয়েছে তা খুঁজে মরছে।
জীবনের ভীষণ রকমের জট পাকানো ব্যাপারগুলো
হতে কিছুটা দূরে থেকে যে গল্পটা খানিকটা হালকা চালে বলতে চেয়েছেন জয় গোস্বামী, সেটার
নাম “মল্লার নামে যেখানে”। অসময়ে পড়ে পাওয়া মূল্যবান বস্তু পেয়েও যখন সেটা ভোগ করতে
না পারায় ক্ষোভ জন্মায়; সেধরনের ক্ষোভে ফেটে পড়বার আগ পর্যন্ত কবিকে ফাঁদে পড়তে দেখে
খুব হেসেছি। কবিকে পছন্দ করে এমন অসমবয়সী মেয়েটির গায়ে পড়া ভাবে তিনি রেগে যাচ্ছেন।
কিন্তু যেহেতু তিনি কবি, তাই তিনি প্রকাশ্যে রাগতে জানেন না। বরং কপ কপ করে রাগ গিলে
নেন। এমনটা পড়ে হাসি পাওয়াটা খুব অন্যায়? আমার মত ফিচেল পাঠক মাত্রই এ গল্পের ওই পর্বটুকুতে
হেসে উঠবেন এ আমি বাজি ধরেই বলতে পারি।
জয় গোস্বামীর লেখা নিয়ে নতুন করে বলবার
কিছু নেই। শুধু এটুকু বলি...অসাধারণ কিছু উপমা আছে। আছে মুগ্ধ হবার মত সারি সারি বাক্যবন্ধ
“সংশোধন বা কাটাকুটি” বইটা জুড়ে। যা পড়ে আলটপকা 'বাহ্' বলে উঠবেন পাঠক বহুবার। অনেক
ঘটনার উপরেই আমাদের হাত থাকে না হয়ত; কিন্তু তারপরও “হাসির কথাই তো হচ্ছিল” গল্পে ধারাবাহিকভাবে
চরিত্রগুলোর স্খলনের কাহিনি হজমে কেন জানি কষ্টই হয়েছে। সত্যি বড় কঠিন, আর কঠিনকে ভালোবাসতে
পারাটা আরো বেশিই কঠিন।
লেখকের জবানীতেই এ লেখার ইতি টানছি,
“অবিরাম কাটতে কাটতে সত্য শতচ্ছিন্ন, তবুও সত্যরূপটা একদিন ধরা যাবে। আর আজকের পৃথিবীতে,
আজকের সময়ে, সত্য কি শতচ্ছিন্ন নয়? আমাদের শতচ্ছিন্ন মনের মত?”
বই: সংশোধন বা কাটাকুটি
বইয়ের ধরন: গল্পগ্রন্থ
লেখক: জয় গোস্বামী
প্রকাশনী: আনন্দ পাবলিশার্স
পৃষ্ঠা- ১৬৯
ISBN:
81-7756-124-3
লেখিকা বাণী বসু করেছিলেন এই গল্পবইয়ের আলোচনা, অনেকগুলি বছর আগে। আর এইটা পড়লাম। বেশ লাগলো। গল্পগুলি নিয়ে কোনো কথা হবে না। অতি উত্তম।
ReplyDelete