১.
"অনুভব কোনো প্রশ্নের উত্তর নয়। সময়, স্বদেশ, মনুষ্যত্ব– কবি,
কবিতা, কবিতার পাঠক– কোথাও যদি একসূত্রে বাঁধা যেতো? হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর
পাওয়া যেতো। হয়তো একদিন সব প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে, যেদিন আমরা সবাই মিলে
পরিশুদ্ধ হবো!"
এ কথা লিখেছেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৮০ সালে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায়।
এর বছর খানেক বাদে, একটি অতি সংক্ষিপ্ত কবিতা লিখলেন বীরেন্দ্র, যা গ্রন্থভুক্ত
আকারে প্রকাশ পেল ১৯৮২তে। দেরিদা বা রোলা বার্থ সম্পর্কে আগ্রহ তখনও মাথা চাড়া
দেয়নি এদেশে। পাঠক-পাঠ্য-লেখক সম্পর্কের বিন্যাস তখন-অব্দি বাংলায় অনালোচিত। এই
কবিতায় অজান্তেই ছন্দ মিশে গেল ডিসকোর্সে, ডিসকোর্স লুকিয়ে পড়ল পোস্টমডার্ন
ধারণার দরজার আড়ালে। এখানে পাঁচের মাত্রাবৃত্তের লিরিক কেটে-কেটে বসে গেছে কবির
মুখে; বলা যায় মানুষেরই ঠোঁট ও জিভের উজ্জীবিত স্পর্শে। প্রাণধর্ম বা অনুভব কোনও
প্রশ্নের উত্তর নয় বলে ঘোষণা করলেও সরাসরি পাঠকের (বা শ্রোতার!) মগজে অনুভূতির
আলো ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি এই ছোট্ট কবিতায়:
"কবিতা
তুমি কেমন আছো?"
"যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ
অপমানে।" (আমার। কাব্যগ্রন্থ: এই হাওয়া)
একেবারে নামকরণ থেকেই যদি এ-কবিতার পাঠ শুরু করা যায়, তাহলে কবির
ব্যক্তিগত মানস-সংসারের গভীর বিষণ্ণতা টের পাওয়া যায় সহজেই। দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তার
ঝোঁক ফরাসি প্যারোল মনে পড়ায় না এখানে? পাশাপাশি, এক অপমানিত ভালোবাসার
পারসনিফায়েড মুখ ভেসে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু স্তরের পর স্তর পেরিয়েও সাধারণ
মানুষের জীবনকেই কি আঁকড়ে ধরতে চায় ভাষা?
২.
"প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়, প্রশ্ন করাটাই হয়তো কবির ধর্ম।"
শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় লিখেছেন বীরেন্দ্র। তাঁর এই বক্তব্যকেই ধারণ করে আছে শঙ্খ
ঘোষের বলিষ্ঠ একটি কবিতার (যা শুরু হচ্ছে এমন লাইন দিয়ে: 'যেদিন নদীর জলে ভেসেছিল
দু'হাজার শব') শেষ পঙক্তি: 'সেদিনও কি জানতে চাও তাহলে কবির ধর্ম কী?'
অনন্তবিস্তারী চড়াই-উৎরাই রাস্তার মতো কবিতার ভাষা বা ডিকশন। বাংলা
কবিতায় এই ভাষাকে মধুসূদনের তৎসম জাঁকজমক ভেঙে এক গহন কোমলতার ঘর দিয়েছিলেন
রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র-পরবর্তী পাঁচ শীর্ষস্থানীয় কবি আবার সেই
স্বরনিক্ষেপ-প্রণালীর ঘরানাকে দিলেন আপাত-জটিল দার্ঢ্যের বাহিরানা। নতুন
গড়ে-উঠতে-থাকা কাব্যভাষায় দশক বিভাজন শুরু হয়নি তখনও। স্পষ্ট কোনও ইচ্ছাকৃত
পন্থা নির্দিষ্ট হওয়ার আগেই কিন্তু কবিতাকে মুখের ভাষার জমিতে এনে দাঁড় করিয়ে
দিলেন জীবনানন্দ-পরবর্তী তরুণ কবিরা: সুভাষ-বীরেন্দ্র-নীরেন্দ্রনাথ-সুকান্ত। এদের
ঠিক পরে-পরেই হই হই করে আরম্ভ হয়ে যাবে দশক বিভাজন। ইউরোপীয় আধুনিকতার বিভিন্ন
তত্ত্বের সঙ্গে ভারতীয় নাগরিকতার বোধ মিলিয়ে-মিশিয়ে কিছু-বা দুরূহ, কিছু
কুয়াশামণ্ডিত ভাষায় এসে পড়বেন
শঙ্খ-শক্তি-সুনীল-অলোকরঞ্জন-বিনয়-আলোক-তারাপদ-প্রণবেন্দু-উৎপল অর্থাৎ পঞ্চাশের কবিগোষ্ঠী।
এরপর থেকে ভাষায় খানিক পাঠক-সংযোগপ্রবণতার বৃদ্ধি দেখতে পাওয়া যাবে—
ভাস্কর-জয়-রনজিৎ-সুবোধ-পার্থপ্রতিম-শ্যামল-মৃদুল...— সত্তরের যে সমস্ত কবির
কণ্ঠস্বর গানের নিজস্বতার মতো দূর থেকে শুনেও এক শ্রুতিতেই চিনে নেওয়া যায়,
তাদের মধ্যে পঞ্চাশের প্রথাগত উচ্চারণ-কাঠামোর গুরুত্ব খানিক লঘু করে দিলেই
প্রকাশিত হয় সরাসরি কথা বলার প্রবণতা, বিশেষত ভাস্কর-সুবোধ-শ্যামলের সিগনেচারে।
তবে জয় গোস্বামীর কবিতা আমাদের শেখায় বিপুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্ভাবনার পথ—
সনেট সেসটিনার আয়তাকার কাঠামো ছেড়ে হরিণের জন্য একক ধারাবিবরণী, ব্যক্তিগত
লিরিক-অনুভব থেকে সূর্য পোড়া ছাই— সমস্তটাই যখন হয়ে উঠেছে কবির আত্মজীবনীরই অংশ।
তাহলে নব্বই-পরবর্তী কবিতায় সুরসপ্তকের নব্য-রোমান্টিক মন্দ্রতার দিকেই কি একটু
ঝুঁকে পড়তে চাইবে স্বরনিক্ষেপণের তরাজু? অথবা সে উঠে দাঁড়াবে ঢেউয়ের চড়াইয়ে
একেবারে তুফানি ঝাপট খেতে-খেতে? ভাষাকে ধারালো রাখা যাচ্ছে না কি কিছুতেই আর?
নব্বই অবশ্য সরাসরি কথা বলাকেই বেছে নিতে পেরেছিল এক সময়। কিন্তু আজ সমাজ যখন
ফিরে যেতে চাইছে মধ্যযুগীয় অন্ধত্বে, তখন ঠিক কীরকম রাস্তা হবে একজন কবির? কিংবা
একজন বিজ্ঞানীর? অথবা একজন সাধারণ মানুষেরই-বা?
৩.
'আমার' নামধারী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আলোচ্য ছোট্ট কবিতাটিতে বিংশ
শতাব্দীর উৎরাই-ধর্মের যোগসূত্রে কোনও দ্বিমেরুতত্ত্ব কিংবা ফেমিনিজ়ম-সহনীয়তা
আসার প্রশ্ন ছিল না। বরং এসে পড়েছিল মানবতাবাদী 'মানুষ' শব্দটি। হয়তো এলিয়টীয়
ব্যক্তিনিরপেক্ষ জড়মনের মধ্যে জারিত আবেগ-অনুভূতির অভিজ্ঞতা এবং প্রথাচেতনার
চিরন্তনতা ছিল এই মানুষের ধারণায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মুখে আমরা যে-মানুষের
কথা উচ্চারিত হতে দেখেছি বহুল আবেগে, যার কান্নার পাশে পশুপাখির নৈসর্গিকতা আমাদের
দরদি করেছে, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বাস্তব ছাড়িয়ে, সেই মানুষ বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় দেখা দিয়েছিল বারবার। বীরেন্দ্র নিহিলিস্ট নন, ঋণাত্মক
ছিল না তার মানবমুখিতা: "কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে ব'লে/ আজও তার
নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল" মনে করেছেন তিনি, বলেছেন: "কারো/ সাধ্য নেই
একেবারে নষ্ট করে তাকে।" পূর্বজের এই উত্তরাধিকার স্বীকার করবে পঞ্চাশের
কবিতা। স্বীকার করবে আরও এক ব্যক্তিচেতনা: "তোমার তো প্রতিদিন জন্মদিন"।
আমাদের আজকের আলোচ্য কবিতায় 'কবিতা' চরিত্রটিকে প্রশ্ন করছে যে-কবি, তাঁর অবস্থান
আমরা হয়তো পেয়ে যাই 'জন্মদিনের কবিতা'য়: "যে মন্ত্র বহুদিন আগে উচ্চারিত
হয়েছে তোমার কণ্ঠে, তোমাকে ঘিরে থাকা বহু মানুষের কণ্ঠে, এখনও তা কয়েকটি আশ্চর্য
শব্দের পবিত্র আকাঙ্ক্ষা..."।
তাহলে মানুষ অর্থাৎ ভালোবাসার মানুষই উপজীব্য একজন কবির? যতই সে ধর্মের কথা
বলুক, যতই সে বিজ্ঞান চেতনার কথা বলুক,— যত উঁচু বা নিচু স্বরেই বলুক না কেন তার
কথাগুলো— শেষ পর্যন্ত তাহলে সে অপমানিত ভালোবাসার মানুষের কথাই কি বলতে চায়
বার-বার?
আবৃত্তির মঞ্চে বহুশ্রুত বীরেন্দ্রর 'রাস্তা কারও একার নয়' কবিতায়
কেন্দ্রস্থলের ক্লাইম্যাক্সে এবং একেবারে শেষের অর্ধসমাপ্ত আশাবাদী অবতরণভূমিতে দুই-দু'বার
উচ্চারিত হতে হল 'মানুষ' শব্দটিকে: ধর্ম যতদিন দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস
দেয়, ততদিন রাস্তা নিয়ে কারও সঙ্গে তার ঝগড়া থাকে না। রাস্তা কারও একার নয়।...
কেউ কারোকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না, যতদিন এই পৃথিবীতে গান থাকে, গানের মানুষ থাকে,
স্বপ্ন থাকে।"
কেমন মানুষের মূর্তি গড়েছেন শুভবোধসম্পন্ন বীরেন্দ্র? বিজ্ঞানচেতনাসম্পন্ন
প্রকৃত আধুনিক তাঁর রুচিবোধের আগুন। শিল্পীসত্তায় তিনি কখনও-বা মাইকেলেঞ্জেলো,
আবার পরক্ষণেই নিরাপদ ঘেরাটোপ থেকে 'পোপের ভয়ে দেশান্তরী' লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।
'মাইকেল এঞ্জেলো: একটি অনুভব' কবিতায় লিখছেন তিনি: "আমি যখন পাথর ছেনে
মানুষের মূর্তি গড়ি/ অথবা গির্জার খিলানে আধশোয়া অবস্থায়/ ওপরের দিকে মুখ করে
তার ছবি আঁকি/ তখন সে ঈশ্বরের সমান"। অথচ, সাধারণ কর্মব্রত থেকে মোটেও
বিচ্যুত হয়নি তার ঈশ্বরত্ব— "আমি মাইকেল এঞ্জেলো, একজন সাধারণ মানুষ, আমার
শিল্পেও সেই সাধারণ মানুষের শ্রম ও রক্ত লেগে আছে।"
পরক্ষণেই কিন্তু অন্য একটি কবিতায় বীরেন্দ্রর কবিসত্তা উঠে দাঁড়ায়
চরিত্র পাল্টে, এক অন্য মনুষ্যত্বের সমর্থনে আত্মচিৎকার করতে করতে: "আমি
মাইকেল এঞ্জেলো নই/ সব অপমানের ভিতরেও যিনি বিশুদ্ধ শিল্প রচনা করেন;/ ভণ্ড
ধর্মীয় গুরুকেও/ যিনি পাথর কেটে মানুষ বানান পাপকে পুণ্য ক'রে/ ধর্মেই তাঁর
আসক্তি, আমি বিজ্ঞান ছাড়া কোনো মানবধর্ম জানি না" (লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, ১৭
জুলাই ১৯৮৪)।
এই রকমভাবেই চরিত্রের গভীর ঘাত-প্রতিঘাতে কবি নিজের আমিত্ব আর তার
'ভালবাসার মানুষ'-রূপী কবিতা-র তুমিত্ব পাঠকের সামনে রেখে গেছেন। জন্মশতবর্ষে, সেই
অনুপস্থিত কবিসত্তার আলোকিত উপস্থিতিটুকু আমাদের মনে ঘুরপাক খায় এক অনুত্তর
প্রশ্নচিহ্নের মতো। আমরা নতুন দিনের কবিতায় অজান্তেই ধারণ করতে থাকি বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের অশেষ কবিজন্মের উত্তরাধিকার। অতীত ও আগামীর মধ্যে কবিতার প্রকৃত
সংযোগ-সম্ভাবনা কি এমনই হওয়ার কথা নয়?
No comments:
Post a Comment