Thursday, August 29, 2019

সুবিনয় হেমব্রম: :শব্দগুলি ছুঁড়ে দিয়েছ পাথরে







শব্দগুলি
শব্দগুলি ছুঁড়ে দিয়েছ পাথরে; পাথরে তারা না গান,
না কান্না। শুধু ইতস্তত আগুনের ফুলগুলি,
নাকি রক্ত, লাল আর কালো অন্ধকারের ভিতর...
তারপর আর কিছুই দেখা যায় না, আর কিছুই
শোনা যায় না। শুধু পাথর যা এখন নিঃশব্দ,
শুধু আগুন যা এখন অদৃশ্য... আর, তোমার সর্বনাশ
 
আমার ভৌতিক জটায় বেঁধে নিয়ে আমি এই রাস্তায় ঐ রাস্তায়
খুঁজে বেড়াচ্ছি একটা অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ।
(পূর্বে অগ্রন্থিত, ১৯৭৯তে লিখিত একটি কবিতা দে'জ প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ কবিতায় স্থান পেয়েছে)

এই কথাগুলো এই কথাগুলোর মত করে লিখলে কবিতা হয়? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পড়লে, এই প্রশ্নই প্রথম আসে বোধ হয় সবারই। অনেক অনেক কথা বলেছেন কবি সারাজীবন। বলে গেছেন প্রতিটি লেখায়। কতটা পৌঁছেছে, সেই প্রশ্ন অমূলক নয়। কারণ সত্যি যা বলেছেন তিনি ক্রমাগত, যাদের যাদের বলেছেন, তা যদি একটুও ছুঁতে পারত, আজ তবে আমরা দরজাটা খুঁজে পেতাম। আমরা তো আজও "চারিদিকে কশাইখানার মধ্যে ছ'ফুট মাটির নিচে চুপচাপ স্থির ব'সে আছি। কোথাও জানলা নেই, দরজার কথা ভাবা অসম্ভব, কেন না বাতাস ঢুকলে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, হতে হবে। কেন না ঘরের মধ্যে, ঘরের বাইরে অন্তহীন দ্বেষের আগুন।" (ভিসা অফিসের সামনে, ১৩৭৪)। দরজাটা আজও অসম্ভব। তিনি লিখেছিলেন সেদিনকার কথা। আমরা কিচ্ছু এগইনি। বরং পিছিয়ে গেছি। 'অন্তহীন দ্বেষের আগুন' আমাদের আজও বিধ্বস্ত করে চলেছে। চারিদিকে থিকথিক করছে মানুষের নির্বুদ্ধিতা ছেলেমানুষি, আর আজকে আমাদের কবিতা চলেছে ব্রহ্মাণ্ডলোকের সন্ধানে! তিনি আজ কতদূর আছেন, ভিন্ন প্রশ্ন।  কিন্তু তাঁর দরকারটা প্রবলভাবে আছে আজও। এমন এক কবি যিনি অনেক অনেক বলতে কসুর করেননি। অনেক বলে ফেলা তো কবিতার জন্যে দুর্বলতা আমাদের নিক্তিতে। কিন্তু তিনি বলে গেছেন... কী হল, কী হয় বলে, না বলেই কী হয়, এই প্রশ্নের মিমাংসা আজও হয়নি, কালও হবে না। তিনি বলেছেন। আবার কখনও সময় সময় না বলে চুপ, শব্দহীন নৈঃশব্দ্যহীন শূন্যে ও নৈঃশূন্যে ঝাঁপ দিতেও দ্বিধা করেননি সময় সময়।
শব্দগুলো ছুঁড়ে ফেলে, মানুষ কখন চুপ করে যায়? বিক্ষোভে? হ্যাঁ, বিক্ষোভে করে। নীরবতা এক কঠিন অস্ত্র। তাই দিয়ে লড়াইয়ে নামলে কেউ হেরে যায় না কখনও। আর ভালবাসা নীরব করে না? হ্যাঁ, সেও করে। ভালবাসাহীনতাও করে। কান্না করে। একাকীত্ব, সেও। যখন শব্দগুলো পাথরে ছুঁড়ে দিতে হয়, যেকারণেই দিতে হোক, তা কি অসহায়তা না উত্তেজনা? নাকি বদলের আভাস? বদল হলে কোথা থেকে কোথায়?
পাথর কেন? তার গুণ কাঠিন্যের জন্য? না স্থিরতা? নাকি তার ভার? শব্দগুলি পাথরে গান বা কান্না কোনওটাই নয়। তাহলে কী ভার, থম মেরে বসে থাকা বিষণ্ণতা? মনে হয় তাও নয়। তার পরের লাইনেই তাহলে আগুনের ফুল কোথা থেকে আসবে! আগুনের ফুল! এই প্রথম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এলেন। অন্ধকার ঝিকিয়ে উঠল। কেন উঠল? শব্দে পাথরে সসংঘর্ষের ফল? কবি সন্দেহ করেছেন, তা রক্ত কিনা! পাঠকের প্রত্যয়, তা নয়। কারণ,  রক্তে যন্ত্রণা আছে এত তীব্র, যে সেখানে বিষণ্ণতার অবকাশ নেই। সুতরাং বিষাদ এই কবিতার ধরতাই নয়। পাথরের ফুল ফোটে অন্ধকার হারাতে হারাতে। সব যন্ত্রণা সব রাগ অন্ধকারে ডুবে যায়, রক্ত কালো হয়ে আসে, আমাদের সেই অন্ধকারে এগতে হবে।
"তারপর আর কিছুই দেখা যায় না"। বলাই বাহুল্য, "আর কিছুই শোনা যায় না"। অন্ধকারে কিছু দেখার নেই বলে দেখা যাচ্ছে না?  শব্দগুলো পাথরে ছুঁড়ে দিতে হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে না? কিন্তু নৈঃশব্দ্যরূপ পাথর তো রয়ে গেছে। তার তবে ভূমিকা কী? আর সেই আগুনের ফুল? সে কখন অদৃশ্য হয়েছে? ফুল নিভে গেছে? নাকি অদৃশ্য, কিন্তু রয়েছে? অদৃশ্য আগুন সম্ভব? কেন নয়? সব আগুন দৃশ্যমান নাকি! বরং যে দৃশ্যমান নয়, সেই আগুনই বেশী মারাত্মক! তার জ্বলন ভেতরে ভেতরে। কবে সে কোনখান থেকে মুছে দিতে শুরু করে, কিছুই জানা যায় না। শুধু হঠাৎ একদিন  বিস্ফোরিত হয়। সেই জন্য, সে সর্বনাশ তোমার! তুমি যে এতদিন কথার আড়ালে লুকিয়ে ছিলে, ধরা দাওনি নিজেকে, নৈঃশব্দের অন্ধকারে তুমি জ্বলে যাচ্ছ এবার ভেতরে ভেতরে।
দহন আশ্চর্য এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া! হয়তো আগুন থেকে বহুদূরে আমি। মনে হচ্ছে বেশ তো শান্ত আছি। কিন্তু সে আমার ভেতরেও দহনক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। বিনা প্ররোচনায় সে তার আশেপাশের বাতাস শুকনো করতে শুরু করে দিয়েছে। সেই বাতাস শুকনো করছে তার চারিপাশ, 
চারিপাশের
  চারিপাশ 
সেই শুষ্কতার সন্ত্রাসবৃত্তে আমাকেও কখন টেনে নিয়েছে, এবার পৃথিবীর সব আগুন সবদিক থেকে আমাকে শুকিয়ে দ্রাহ্য করে তুলবে, একদিন হুহু করে জ্বালিয়ে দেবার
  ষড়যন্ত্রে। শুধু আমাকে? একটুকরো আগুন সারা পৃথিবীকে তার বৃত্তের মধ্যে টেনে আনে নীরব সন্ত্রাসে।
'তোমার সর্বনাশ'। 'তুমি' কে এখানে? কার সর্বনাশ? কোনও শত্রুপক্ষের? এই কবিতায় আপাত কোনও শত্রুপক্ষ নেই। কবি এখানে ভেতর থেকে আহত! তুমিটা তাহলে তুমি নয় আমি? আমারই সর্বনাশ? সর্বনাশ কী? ফের পড়ি কবিতাটা আসুন: "শুধু পাথর যা এখন নিঃশব্দ, শুধু আগুন যা এখন অদৃশ্য... আর, তোমার সর্বনাশ"। নিঃশব্দ পাথর আর অদৃশ্য আগুনের সমভিব্যাহারে আসে সর্বনাশ। তোমার বা আমার, সে মিমাংসা চলতে থাকুক। আমি "আমার ভৌতিক জটায় বেঁধে নিয়ে" এই সব সর্বনাশ, চলেছি অন্যকিছুর খোঁজে। কীসের খোঁজ আমরা পড়ব শেষলাইনে, তার আগে এই লাইনের মেজাজে কিছু  নেওয়ার আছে। সর্বনাশকে জটায় বেঁধে নিয়ে চলার যে তাচ্ছিল্য যে বৈরাগ্য যে বোহেমিয়ান চৈত্ররাগ, সেটা খেয়াল করতে হবে। জটায় বেঁধে চলেছেন কে? মহাকাল? যার কাছে সব তুচ্ছ। জটার অনুষঙ্গে মহাকালের আভাস খুব সরলভাবে আসে।  'আমরা সবাই চাঁদের আলোয় বামন" ১৯৭১-এ লিখেছিলেন। সেই বামন-পৃথিবীকে তাচ্ছিল্য করে সব নৈশব্দ সব অদৃশ্যকে জটায় বেঁধে নিয়ে এই রাস্তায় ওই রাস্তায় আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ এই কবিতার শেষ লাইনে নিজেই এক বিস্ময়।  আলাদিনের জাদু চিরাগ, তার থেকে দৈত্য এসে নিমেষে সব আকাঙ্খা  পূর্ণ করে দিচ্ছে, এই জন্যে এত অদৃশ্যের এত নৈঃশব্দের এরকম আয়োজন? প্রদীপ হাতে পেয়ে আলাদিন দারিদ্র্য থেকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল, এই পাওয়ায় তার কোনও কৃতিত্ব ছিল কি? হ্যাঁ সে সৎ ছিল, সরল ছিল-- এই পর্যন্তই। জীবন কি সরলতার উপহার হতে পারে? কোনও লড়াই থাকবে না! আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ কি কেবলমাত্র একটা শেষলাইনের চমক?
তা নয়। ভুলে গেলে চলবে না, এ অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া প্রদীপ। একজন কবির একটি নির্দিষ্ট কবিতাই তো সেই কবিতাকে বোঝার একমাত্র পথ নয় কখনও। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর আমাদের আমূল ছুঁয়ে আছে। সেই থাকার পূর্বসংস্কার আমাদের ছেড়ে বেরুতে পারলে, কবিতাটি এখানেই শেষ। কিন্তু বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেই আমাদের আরও যেতে হবে।
অনেক দিনের হারানো প্রদীপ। কতদিন? উত্তর নেই। তাই যদি পিছিয়ে যাই শিকারী সংগ্রহী মানবের আদিম সমাজে, কোনও বিরোধ নেই। আলাদিনের প্রদীপ তো একটা স্বাধীনতা। যা চাই, তা-ই পাওয়ার স্বাধীনতা। প্রকৃত স্বাধীনতা তো তা-ই। যা না-পাওয়া আমাদের বিষণ্ণ করে রাখে সমস্ত জীবন। সবাই মনে মনে একবার না একবার পেতে চাই আলাদিনের প্রদীপ। পেলে কী চাইব তার তালিকা বারবার বানিয়ে রাখি আমরা, এই অহসায় আকাঙ্ক্ষার ক্রীতদাসগণ! চাই চাই চাই! কিন্তু পাই না। বিষাদ ঘিরে রাখে জীবনের প্রতিটা প্রলেপ।
কী চাই এত? কে আমাদের দিয়েছে এত চাহিদা? এই সময়ই তো? যদি ফিরে যাই...? আলাদিন রাজপ্রাসাদ চেয়েছিল। চেয়েছিল? এত নিশ্চিত হলাম কী করে? আলাদিন তো একটি গল্প। বাস্তবের আলাদিন হয়তো অন্যকিছু চেয়েছিল। কারণ রাজত্ব রাজপ্রাসাদ... এ তো আমাদের আকাঙ্ক্ষা, সময়ের বানিয়ে তোলা অসুস্থতা। জীবন কি অসুস্থতার ফুল? হলে তা একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। আলাদিনের প্রাসাদও উধাও হয়ে গিয়েছিল। জীবনের প্রকৃত চাওয়া তো অন্যকিছু। সেই সামান্য পাওয়ার স্বাধীনতা যদি আলাদিনের প্রদীপ হয়, তাহলে তা একদিন আমাদের হাতে ছিল। অনেক অনেক দিন আগে তা হারিয়ে গেছে। কবির রাজনৈতিক বিশ্বাস, আমরা জানি, সেই আদিম সাম্যাবস্থা। তিনি তা ফিরে পেতে চান, অন্ধকার গুহায় যেভাবে আলাদিন চেয়েছিল একটুকরো বাতাস, চেয়েছিল একটা দরজা। সর্বনাশকে জটায় বেঁধে মহাকাল একবার এপথ একবার ওপথ ঘুরছে, সেই আশ্চর্য প্রদীপের খোঁজে, একদিম যা আমাদের হাতে ছিল।
এভাবে কি পড়া যায় লেখাটি? তাহলে সর্বনাশ কার? শত্রুপক্ষ নেই? নাকি অদৃশ্য আগুনের মত সেও আড়ালে? ফের পড়তে হবে লেখাটি। কারণ আজও আমাদের "কোথাও জানলা নেই, দরজার কথা ভাবা অসম্ভব... কেন না ঘরের মধ্যে, ঘরের বাইরে অন্তহীন দ্বেষের আগুন।"


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

সে চেয়েছিলো একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে। তার তো একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে? ...

পাঠকের পছন্দ