Wednesday, August 28, 2019

সৃজন দে সরকার: ফুটপাথের কবিতা ও ন্যাংটো ছেলেটি





ফুটপাতের কবিতা :
ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বাড়ায়।
যদিও তাঁর খিদেয় পুড়ছে গা
ফুটপাতে আজ লেগেছে জোৎস্না-
চাঁদ হেসে তার কপালে চুমু খায়।

লুকিয়ে মোছেন চোখের জল, মা।

ফুটপাতের কবিতা :
পেটের আগুন খিদে
হাঁঠতে শিখেছে।
গলার রক্ত খিদে
পৃথিবী দেখছে।

হাতদুটি তার খিদে
কেবল বলে : ‘দে’।
পা দুটি তার খিদে
পৃথিবী গিলছে।

ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে সংস্কৃত সাহিত্য পলির পাশে এক টুকরো প্রাকৃত ভাষার চূর্ণ কবিতার দেখা মেলে ‘গাহাসত্তসয়ী’ বা ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’-এ। সেগুলি বিরাট কবিতা নয়, আকার কিংবা পদসংখ্যাতে, তবে এদের ভাব অনেক গভীর, এদের দাবী অনেক মজবুত। এ ধরণের ছোট কবিতাই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘অসহায়’। এই অসহায়তা এতটাই যে ‘কেউ তাকে খুঁজে পায় না, কবিতার পাঠক না, যিনি কবিতাটি লিখছেন তিনিও না।’ যদিও এদের মধ্যেই ‘তাদের নিজেদের অস্তিত্ব...শুধু নিজেদের অনুভবটুকু সামান্য গুছিয়ে বলাতেই তাদের সব দম ফুরিয়ে যায়।’ তবে শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব অনুভবের ভাষা প্রকাশ দম ফুরানো কবিতারাই কবির ‘আসল মেজাজ অথবা ধর্ম তাকে সযত্নে বহন করছে।’
‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ নামের কবিতাবলীতে শেষ দুটি এমনই। প্রায় তিন বছরের ব্যবধানে লেখা কিন্তু গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বক্তব্য। প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে প্রথমটি (১৯৭৯)-র সময় তিনি ট্রিপাড়া চা বাগানের কলকাতায় দফতরির কাজ ছেড়ে অনুবাদে আসেন। আর দ্বিতীয়টি (১৯৮১, ২১ মার্চ)-র উনি নরসিংহ দাস পুরষ্কার পান। তবে এ’দুটির প্রমাণ এতে না এলেও পরোক্ষে তা ছুঁয়ে আছে বলে মনে হয়।
দু’টি কবিতাই লেখা হয়েছে দলবৃত্ত বা ছড়ার ছন্দে। ফুটপাথের ন্যাংটো ছেলেটির কবিতা হলেও তা যে ছড়ার ছন্দে হতে পারে এটাই বিস্ময়। যদিও প্রথমটি ব্যক্ত চরিত্রে দ্বিতীয়টি অব্যক্ত চরিত্রে প্রকাশিত। তবে প্রথমটি শ্লেষ ও বিদ্রুপ আর দ্বিতীয়টি ভাব ও কালের গভীরতা অনেক বেশি।
যে ন্যাংটো ছেলেটির কথা এ কবিতা, যার বস্ত্রেরই অভাব সে ছেলে ভুলানো ছড়ার মায়ায় আবদ্ধ। সে আকাশে হাত বাড়ায়, ফুটপাথে নামে জ্যোৎস্না, চাঁদ হেসে কপালে চুমু খায়। তবে ছেলেটি আকাশের দিকে হাত বাড়ানোর ফল ‘তার’ পেট নয় সমগ্র শরীর আগুনে পোড়ে। তাও ফুটপাথে জ্যোৎস্না নামে, সেই ‘তার’-এর কপালে চাঁদ চুমু খায়। বাস্তবতার এই চিত্র যেন চাঁদ জ্যোৎস্নার আড়ালে এনে দাঁড় করায় ফুটপাথের জগৎ থেকে অনেক দূর আকাশে অবস্থিত বিত্তবানদের। যারা পারে না কখনই গা পুরে যাওয়া খিদে মেটাতে। তাই তো লুকিয়ে চোখের জল মুছে নেন মা। ‘মা’ শব্দটি আলাদা ব্যবহার অন্ত্যানুপ্রাস (-গা, -মা) হলেও তা আরও বর্ধিত অর্থে হয়ে ওঠে জননী জন্মদাত্রী বসুন্ধরাও। ফুটপাত যার কোলে, ন্যাংটো ছেলেটি যার কোল, কিন্তু চাঁদ ও জ্যোৎস্না আকাশের গায়ে- মায়ের কোল থেকে সে চির বঞ্চিত।
দ্বিতীয়টিতে আর এক অব্যক্ত চরিত্রের কথা আসে আড়ালে। এতে খিদের আগুন দেখা দেয় পেটে, গলার রক্তে, হাতে, পায়ে। কার্যত এটি ‘খিদেয় পুড়ছে গা’-এর সমার্থক। তবে, এর ব্যাঞ্জনা অন্যত্র। প্রথম দুটি খিদের সমর্থে বলা হয়, অব্যক্ত চরিত্র ‘হাঁঠতে শিখেছে’ এবং ‘পৃথিবী দেখছে’। এটা নিঃসন্দেহে একটা শিশুর আচরণ। কিন্তু শেষ দুটি খিদের সমর্থে বলা হল “কেবল বলেঃ ‘দে’” এবং ‘পৃথিবী গিলছে’। এটা কোন প্রাপ্তবয়স্কের স্বর যে নিজ বুদ্ধি দিয়ে দু-হাতে চাইতে জানে। অথচ, ‘পৃথিবী’র দুটি কৃতকার্য বলে দেয় অন্য কথা, তাতে বসুন্ধরা নেই, এই পৃথিবী বিত্তবানের পৃথিবী। প্রথমে যে ছিল শিশু, যে হাঁটতে শিখেছে, তাকে সে দেখে নিচ্ছে। এই দেখে নেওয়া এক অর্থে যাছাই করে নেওয়া। বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়, যখন সেই শিশু হল প্রাপ্তবয়স্ক, সে তখন কথা বলতে পারে, চাইতে পারে বস্তু, করতে পারে দাবী। এরপরেই আর তাকে কোন সুযোগ দেওয়া নেই- তাকে ‘গিলছে’।
চিরন্তন ফুটপাথের দুটি ভিন্নস্বর এখানে স্পষ্ট হল। যা বহমান রেখেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই ‘সাদামাটা কবিতা’ তে। তিনি নিজেই বলেন, ‘এদের জন্য কোন সাতমহলা বাড়ির দরকার হয় না।’   

তথ্যসূত্র-
১) সমস্ত উল্লিখিত উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে ‘আমার কবিতা’, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি, জানুয়ারি ২০০০ থেকে।       

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

সে চেয়েছিলো একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে। তার তো একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে? ...

পাঠকের পছন্দ