Wednesday, August 28, 2019

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া: রূপকথায় রক্ত লেগে আছে



          




চারপাশের নানা অন্ধকারে আজকাল শিঁটিয়ে থাকে মনঅতর্কিত ব্রেকিং নিউজে হকচকিয়ে যাই আর তড়বড়িয়ে বেড়ে ওঠা অন্ধকারে চাপা আওয়াজ আসেধর্ষিতা মেয়েদের গোঙানি, ছেঁড়া কাঁটা ভূস্বর্গের ওপর ভারী বুটের টহলদারির শব্দ, কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসা বেকসুর খালাস অপরাধীদের হাসি,রেইন ফরেস্টর প্রকান্ড মহীরুহগুলির মাটিতে আছড়ে পড়ার আর্তনাদ আর ভোররাতে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠি,দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে এ দেশের ভুগর্ভর জল, নরম পানীয়ের কোম্পানিগুলি তাহলে কেন?কেন নদীদের মেরে ফেলছি আমরা?আর দীর্ঘ অবসাদে ডুবে যাচ্ছে মনপা টেনে টেন কাঁটা ঝোঁপের আড়ালে ঘুমিয়ে পড়ছে আহত পশুর মতো মন
      পাথরের মত জমে যাওয়া এই অন্ধকারে শতবর্ষে পৌঁছে যাওয়া কবির কবিতার কাছে আজও কিভাবে আলো চাইতে পারি ভাবতে ভাবতে পাতা ওল্টাই আর এক আরম্ভের জন্যগ্ৰন্থটির,আর হওয়া না হওয়ার গল্পকবিতাটির সামনে থমকে দাঁড়াই
        সহজ অপাবৃত এক ভাষা যার সৌন্দর্য্যবহু ব‍্যবহৃত সাদামাটা শব্দবন্ধ ও নামকরণ যা আপাতনিরীহ কিন্তু এই সরলতার ব‍্যবহার এতো চমৎকার যে নিরাভরণ শব্দকেই হিরণ্ময় লাগে যেনখোলা আকাশের নীচে বাংলা সাহিত্যর আদিগন্ত সবুজ মাঠে কবিতার মন্ত্র হাতে করে নির্মল পিপাসার জল খুঁজছেন কবিআদতে এটি প্রেমেরই কবিতাপ্রেমহীনতার কথা বলতে গিয়ে যা অন্য এক প্রেমের কথাই বলে
               এ কথা ঠিক যে বিনোদন ছাড়াও একটি জাতি বা গোষ্ঠীর যাপনের আধার যে সংস্কৃতি এ সম্পর্কে বামপন্থাচর্চাকারীদের উন্নাসিক এক অবহেলা ছিলযৌথ স্বপ্ন বা প্রতিরোধেই তাকে প্রয়োজন নচেৎ নয় এবং ভাববাদ যা প্রাকৃতিক এক নিয়মের কথাই বলে কিন্তু বণিক সমাজ যেহেতু তাকে কাজে লাগায়, রোমান্টিসিজম নিয়ে তাদের ভেতর এক নেতিবাচক মনোভাবই ছিলস্বাভাবিক ভাবেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস রেখে  শিল্পচর্চা করতে গিয়ে  বীরেন্দ্র চট্টপাধ‍্যায় দ্বিধান্বিত হয়েছেন নিজের কাছেই প্রেম প্রকৃতি তাবলে ছেড়ে যায়নি তাকে কোনদিনপ্রজ্ঞার উৎস তাকে বলে প্রেম লেখো আর বোধ হেঁকে বলে, বাস্তবের আগুন পরিসরের চাহিদা মেটাও হে
           সে চেয়েছিল একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে”…শুরুতেই দেখি দেশ- কালের উর্ধ্বে সৃজনশীল এক মানুষ ,বিপ্রতীপ জগত যার বড় চেনা, নেমেছেন নিজের সঙ্গে এক অসম লড়াইয়েতিনি জানেন প্রেমই কবিতার প্রাণ,তার শব্দ,ধ্বনি বা মন্ত্র
        একজন বিজ্ঞানী যেভাবে রহস্যের মুখোমুখি হয়ে তার সূত্র সন্ধান করে,লেখার মধ্যে কবিও অনুভবের উৎস সন্ধান চাইছেনকবিতার জন্যে তার এই জাগর,কঠিন এক সত্যির মতোই তাকে অপ্রেমের তুমুল দাহর মধ্যে ছুঁড়ে দেয় কেননা ধুধু মেঘের অন্ধকারে লক্ষ হাজার পায়ে হেঁটে আসা মানুষ,জ্বলেনি যার ভাতের হাঁড়ি, তারচেয়ে বড় সত্যিওতো কবির জানা নেই
        তাই একটার পর একটা তার নিজের লেখা কবিতা/কি প্রেম কি জল/এমনকি পায়ের নিচের শক্ত মাটি পর্যন্ত খুঁজে পেল না/” কবি নন,সমগ্ৰ কবিতাটিই যেন পাঠককে ডাকে, অন্তর্মুখী অথচ সচেতন এবং অন্তরঙ্গ এক কথোপকথনের ডাক সময়কে পেরিয়ে যেতে দেখিদেখি কবির সব চুল শাদা হয়ে গেছেশীত নেমেছে হাতের পাঁচ আঙুলে তবু অস্থিরতা কমেনি এক ফোঁটাওরাতদুপুরে ঘুমোতে না পারার যন্ত্রণায় এখনো চেঁচিয়ে ওঠেন, ”মাত্র একটি প্রেমের কবিতা”! ছোট ছোট মিড় বা গমক নয়,সপাট তানে ছুঁয়ে ফ‍্যালেন তার সপ্তক আর শ্রুতির অলৌকিক ফুলে জ্বলে ওঠে রাতের কোমলগান্ধার
কবিতার গতিমুখ নির্ধারিত হয়ে যায় তৎক্ষণাৎসেতো এখন চলমান এক তীর, অভিমুখ যার স্থিরতার সাথে চলতে চলতে আমরাও  চাই লেখা এবার প্রেমের কবিতা হয়ে উঠুক অথচ ঠিক তখনই মাথার মধ্যে, বুকের ভেতর কঠিন তিরস্কার হয়ে বেজে ওঠেন কবি,ভর্ৎসনা করেন নিজেকে ও আমাদেরআমরা ফিরে আসি মাটিতেবুড়ো হয়ে গেলি,এখনো স্বপ্ন দেখছিস!”
       যেখানে চারদিকে হেমন্তের রঙ গাঢ় হয়ে আছে, ফসলের ঘেমে ওঠা গন্ধে ঘরে ফিরছে হাসখুশি মানুষ আর আচমকাই তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াচ্ছে যারা তাদের মুখ নেই,কেননা পরিচয়হীন তারাদেখতে দেখতে হলুদ পৃথিবী রাঙিয়ে ওঠে রক্ত আর আগুনে
     
    নিরুপায়, তিনি জিজ্ঞেস করছেন আগুনকেই,”এই কি মানুষের জীবন!” যাবৎ জীবনকাল সমস্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, তাদের সর্বনাশ নিজের জটায় বেঁধে যে সরস্বতী নদীর জলে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন কবি,কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাননি,কবিতার এই বাঁকে পৌঁছে আমরাও বুঝতে পারি তার প্রেমের কবিতাও নিছক কোনো মানব-মানবীর ব‍্যক্তিগত নির্জনতা নয়,তা করুণা ,সহিষ্ণুতা,বিশ্বাসে গড়া এক গভীর শুশ্রূষা জলঅক্ষরের সেই নদী খুঁজে পাননি বলে তার স্নান হয়নি আজও,আগুনে পুড়েই যেন শুদ্ধ হচ্ছেন তাই
               রূপক থেকে মৌলিক এবং মৌলিক থেকে ব‍্যাপকের টানা আর পোড়েনে বোনা তাঁতে  অনন্ত সময়ের সঙ্গী হয়ে যে কবিতাটি উঠে এল,অতলান্ত অপ্রেমের ভেতর তাকে কবি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন এবারশুধু তার শিথানে লালকমলের আগে নীলকমল জাগে- মতো কবি জেগে থাকবেন মৃত্যুর মুখোমুখি
  দ্বিধা দ্বন্দ্বের সংশয়াতীত দোলাচল এ কবিতার অপর ভুবন আজওতো এ কবিতা সমান প্রাসঙ্গিকযখন উন্নাওয়ের মেয়েটি শুয়ে থাকে কোমায়, মধ্য প্রাচ‍্যের পড়ুয়াসমেত উড়ে যায় বাচ্চাদের স্কুল,সিরিয়ার শিশুটি  সৈকতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে,মায়ানমার থেকে হেঁটে আসে অসংখ্য মানুষ এই পৃথিবীতে যাদের দেশ নেই, নির্বিচারে নিহত হয় নদী ও অরন্য তখন দ্বিধা হয় আমাদেরও,আমরা আজ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের,বন্ধুত্বের,হাতে হাত বেঁধে থাকার কথা বলবো নাকি জেহাদের কথা বলবো?কোনটা দাবি করছে এ সময় তা বুঝে উঠতে পারিনা
     আজও আমরা যারা জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে আগুনের উল্টো পিঠে ছাইয়ের ভেতর সভ‍্যতার প্রত্ন চিহ্ন খুঁজতে যাই,স্বজন বান্ধবের শবদেহর সাথে ঘরপোড়া মানুষ যেভাবে কুড়িয়ে তোলে তৈজসপাতি আর দ্বিধাদীর্ণ হই
এই পারা না পারার টানাপোড়েন থেকে আগামী দিন হয়তো নতুন কোনও উপলব্ধির জন্ম হবেততদিন পুড়তে পুড়তে ধ্বংসের সামনে দাঁড়াতে হবে  আমাদের কেননা অনন্ত সময়ের সঙ্গী হয়ে কবি দাঁড়িয়ে আছেন,মৃত্যুর মুখোমুখি তিনি জেগে আছেন


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

সে চেয়েছিলো একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে। তার তো একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে? ...

পাঠকের পছন্দ