চার দশক পার হয়ে গেছে। সেদিন কলকাতার বাতাসে “মুক্ত
হবে প্রিয় মাতৃভূমি”-র সুর, স্বর, আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছিলো। কান পেতে শুনছিলো
ছাত্র-যুবক সমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ। সেটা হাজরা পার্কের কোন এক দুপুরের কথা। বন্দীমুক্তির দাবীতে সুরেশ বিশ্বাস
“শত শহীদের রক্তে রাঙ্গা পতাকা” গাইছেন উন্মুক্ত কণ্ঠে, ট্রাম লাইনের আওয়াজকে
অতিক্রম করে। সাথে গলা মেলাচ্ছে কৈশোর-যৌবনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে –
জয়ন্ত। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হবার আগে জয়ন্ত পড়েছে তাঁর কলম-কালির
জরায়ু ছিঁড়ে জন্ম নেওয়া গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই কবিতার লাইনগুলো –
পিচ্ছিল নেপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ –একা – নরক দর্শন করে
তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
রক্ত মাংস কর্দমের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
নরক উত্তীর্ণ হতে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার;
মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।
কলেজ স্কোয়ারে খাটো ঝুলের পাজামা আর কোঁচকানো ধূসর পাঞ্জাবী পরা লম্বাটে,
রোগাটে কালোর দিকে ঘেঁষা গায়ের রঙের একজন মানুষ তুমি গান করে নেমে আসার পরে বললেন –
“বেশ গেয়েছেন ভাই! খোলা উদাত্ত গলা।” ভেতরে কি এক অনুভূতি তখন! জেনে গেলাম এই
প্রায়-তাচ্ছিল্য করার মতো ভদ্রলোকের নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সমস্ত শরীর জুড়ে
যে অত্যাশ্চর্য, দ্রিদিম দ্রিদিম অনুভূতির নীল সাগরের মতো ঢেউ খেলে গিয়েছিলো সে
মুহূর্তে তাকে কি আবেগ বলে? কোন শব্দে ধরার মতো অবস্থায় ছিলেনা তুমি, জয়ন্ত। তোমার
সামনে ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় আলোর মতো জেগে উঠছে তাঁরই কবিতাখণ্ড।
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ,
উপরে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবা-দ্বিপ্রহরে
নিশাচর শ্বাপদেরা; করুক আহ্লাদ
তার ছিন্ন ভিন্ন হাত-পা নিয়ে
শকুনেরা। কতটুকু আসে যায় তাতে
আমার; যে আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,
“তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।”
তিনি প্রেমের কবিতা লিখলেন – “তিন পাহাড়ের স্বপ্ন”। নিজেরই
মনে হল –
তারপর? তারপরেও কবিতার কথা থাকে –
কোথায় চলেছ তুমি? কত দূর? কীসের অণ্বেষণে?
শুধু বেঁচে বর্তে থাকাই তো একজন
মানুষের অন্বিষ্ট নয়। …. সারা জীবন ধরে তাকে রাস্তার পর রাস্তা হাঁটতে হয়! আর শুধুই
কি রাস্তা হাঁটা? অর্ধেক জীবন তো তার পায়ের নিচে কোন মাটিই থাকে না।
তাই জানতেই তো আমাদের সারা জীবনের
পরিশ্রম – প্রেমের গান গাইতে গাইতে হঠাৎ গলা দিয়ে এক ঝলক রক্ত উঠে আসে। তারপর…কোথা থেকে এত রক্ত
আসে? তোমার নিজের রক্ত?
আর তোমার পায়ের নিচের মাটি? তাকেই
কি তুমি খুঁজে পেয়েছ? অর্ধেক জীবন তো কবে চলে গিয়েছে। … এরপরেও কি তোমার
কিছু ক৯থা আছে? জীবনকে নতুন করে দেখার আছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। কেন
না, সমস্ত ব্যাপারটাই অনুভব করার। অনুভব কোন প্রশ্নের উত্তর নয়। সময়, স্বদেশ,
মনুষ্যত্ব – কবি, কবিতা, কবিতার পাঠক – কোথাও যদি একসূত্রে বাঁধা যেতো? হয়তো অনেক
প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতো। হয়তো একদিন সব প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে, যেদিন আমরা
সবাই মিলে পরিশুদ্ধ হবো!
এখন শুধু এতটুকু কথাই বলতে পারি,
মানুষের আশা অবিনাশী। চারদিকে নরকের মধ্যেও মানুষ তাই স্বপ্ন দেখে। তখন, স্বয়ং
মৃত্যু এসেও যদি তার সামনে দাঁড়ায় – সে তাকে সহজে পথ ছেড়ে দেয় না – প্রশ্ন করে।
প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ণোয়, প্রশ্ন
করাটাই হয়তো কবির ধর্ম।
১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। কদিন আগে ১৮৮৮-র ডিসেম্বরে (তাঁর স্বাক্ষর অনুযায়ী খৃস্টমাস বা ২৫শে ডিসেম্বর)
নীটশে Ecce Homo-র ভূমিকা লিখেছেন। পণ্ডিতেরা অনেকেই এ রচনাটিকে নীটশের
সর্বোত্তম সৃষ্টি বলে থাকেন। Ecce Homo শব্দটিকে আবার
দুটি অর্থে ব্যবহার করা যায়। একদিকে মূল লাতিনে – “ঐ দেখো মানুষ”। আবার আরেক অর্থেও বোঝা যেতে পারে এর শব্দার্থকে, যেমনটা পন্টিয়াস পাইলেট
ব্যবহার করেছিলেন – “a painting of Christ wearing the
crown of thorns”। যাহোক বইটির ভূমিকা লেখার কদিনের মধ্যে নীটশে রাস্তার মাঝে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
আবার হুঁশে ফিরলেন “and then
darkness closed in and extinguished passion and intelligence”। নিতান্ত দেহজৈবিক কারণে কণ্ঠরুদ্ধ হল নীটশের, লেখনীও রুদ্ধ
হল। কিন্তু আমাদের জন্য লিখলেন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা – “My humanity is a constant self-overcoming”, লিখলেন, “At this point the real answer to the question, how one becomes what one is, can no longer be avoided. And thus I
touch on the masterpiece of the art of self-preservation – of selfishness.” বাংলায় বললে স্বার্থপরতা বোঝাতে তিনি আত্মকে সংরক্ষণ বা self-preservation বুঝিয়েছেন, আত্ম- বা অর্থ-গৃধ্নুতা বোঝাননি। এর সাথে কি কণ্ঠরোধের কোন দূরতম
যোগাযোগ আছে? আমার বিচারে আছে। যখন প্রশ্ন আসে “how one becomes what one is” তখন “আমি”-কে খুঁজতে গিয়ে আমার স্বর এবং কণ্ঠের খোঁজ “আমি” করি। কণ্ঠরুদ্ধতার প্রসঙ্গ তখন প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
এরকম এক বিপন্ন, নিঃসহায়, আর্ত মুহূর্তের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন আমাদের কবি
শঙ্খ ঘোষ –
“লিখে যাই জলের অক্ষরে
আমার মেয়েরা আজও অবশ ভিক্ষার হাতে পড়ে আছে সব ঘরে ঘরে।” (শবের উপর সামিয়ানা)
যে জানলোনা “how one
becomes what one is”, জানলোনা self-preservation কাকে বলে সেখানে কোন কণ্ঠ কি উচ্চারণেরজন্য পড়েথাকে? রুদ্ধতা যেখানে আজন্ম সেখানে কণ্ঠরোধ শব্দটির অর্থই ভিন্নমাত্রা নেয়। আমরা যে
কথাগুলো তৈরি করলাম আরেকজনের শ্রবণে পৌঁছে দেবার জন্য, যে শব্দগুলো সত্তার গভীরতম
বিন্দু থেকে উৎসারিত হল নভোমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ার জন্য সেগুলো যদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত
অসমাপ্ত অসম্পূর্ণ বারিকণার মতো জন্ম নিয়েই শুষ্ক হয়ে হারিয়ে যায় তখনও তো আরেক
অবস্থার সৃষ্টি হয় – রুদ্ধতার, কণ্ঠরুদ্ধতার। আবার শরণ নিই শঙ্খ ঘোষের –
“কে তোমার কথা শোনে? তুমিই-বা শোন কার কথা?
তোমার আমার মধ্যে দু-মহাদেশের নীরবতা।”
যখন মনোজগতে বিচ্ছিন্ন, চরা পড়ে থাকা দারুচিনি দ্বীপের মাঝে, নিস্পত্র বৃক্ষ,
বর্ণহীন পুষ্প আর নিঃসার অস্তিত্বপুঞ্জ রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি কথা কইতে চায়? যদি
“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে” দাঁড়ায়, যদি আরেকবার বুঝতে চায় পল এল্যুয়ারের মতো “And by the power of a word I start my life again / I was
born to know you / To name your liberty”? যদি সে হঠাৎ জেনে ওঠে “আদিম অন্ধকারের মুখোস-দেবতা / তোমার
একটিই আনন্দ / আমাদের মুখ ম্লান করে দেওয়া”? (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একটি
অসমাপ্ত কবিতা)
প্রকৃতপক্ষে এরকম এক পরিস্থিতিকে বুঝতে চাইছি, খানিকটা জলছবির মতো, আবার
খানিকটা লেখচিত্রের মতোও – যখন “গলায় যদি ঝুলিয়ে দাও পাথর / হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে
তো আতর / তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে - / …. এ-দুই চোখে দেখতে
দিন বা না দিন / আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন / আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে”
(শঙ্খ ঘোষ, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ”)। কিন্তু রাষ্ট্রের এই বিপুল
উৎসবের মাঝে যখন ভগ্নদূত schitz-এর মতো কেউ একজন
হাত তুলে বলে ওঠে “Ecce Homo –
ঐ দ্যাখো মানুষ” তখন চরা পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো
মানুষগুলো আচমকা বুকের বাঁদিকে পকেটের নীচে থাকা অত্যাশ্চর্য হৃদয়টিকে আবিষ্কার
করে ফেলে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি কবিতারও জন্ম হতে পারে –
দেখ, এই আমার স্বদেশ –
বন্ধুদের হাতে
হাত, ধমনীতে উষ্ণ রক্ত,
সময়ের প্রসারিত
রেখা ছুঁয়ে যায় বুক
করতলে বেড়ে ওঠে রৌদ্রের শিশুরা। (সব্যসাচী দেব, ‘সময় বাহুতে
বাঁধে প্রচ্ছন্ন স্বদেশ’)
এরকম কবোষ্ণ কাব্যভাযাকে অতিক্রম করে আরেকটি কাব্যভাষার জন্ম নেয় আমাদের বুকের
বাঁদিকের সে অত্যাশ্চর্য দেহযন্ত্রটি থেকে –
“এলোমেলো হারিয়ে যাচ্ছ তুমি
লেগে আছে দাগ
মাটিতে ঘষটে নিয়ে যাওয়ার
এই দাগ ধুয়ে যায় না
আরও চেপে বসে
যতদিন না তুমি প্রশ্ন করছ
নিজেকেই
যতদিন না, তুমি ঘুরে দাঁড়াচ্ছ
নিজের বিরুদ্ধে।” (হিন্দোল ভট্টাচার্য, তৃতীয় নয়নে জাগো)
এভাবেই নিরন্তর প্রশ্ন করা চলে। বীরেন্দ্র এক দম বন্ধ
করা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেন আমাদের।
কিবা আসে যায় চাঁদ যদি ফেরে লজ্জায় ঘরে উঁকি দিয়ে
কড়িকাঠে ঝোলে বিবসনা নারী হোবু-কবিদের ফাঁকি দিয়ে
কিংবা সাগর ফুলে ফেঁপে ওঠে, গর্জায় আর চোখ রাঙায়
উজিরের ঘুম ভাঙে অসময়ে, কোটাল সভয়ে বিদেশ যায়
আমাদের চলা এতেই কি শেষ হয়?
দাঁতালো পেরেক তালি-খাওয়া জুতো অনেক কথাই কয়!
কণ্ঠ যখন কথা বলে তখন তার অভিঘাত কিভাবে এসে পড়ে আরো দু-একটি উদাহরণ ইতিহাস
ঘেঁটে দেখে নিই। চার্টিস্ট আন্দোলনের নেতা আর্নেস্ট জোন্স। শ্রমিকদের সংগঠিত
করছিলেন, মার্ক্সবাদের সাথে পরিচয় ছিল, এমনকি প্রভাবিতও হয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ
তখনো অনেক দূরের ব্যাপার। ১৮৪৮ সালের ৬-ই জুন একটি জ্বালাময়ী, “রাষ্ট্রদ্রোহী”
বক্তৃতা দিয়েছিলেন – “green flag of
Chartism will soon be flying over Downing Street.”সেসময় সমগ্র পৃথিবীর অধিশ্বর ব্রিটিশ রাষ্ট্রের কাছে এ কি কোন সহনযোগ্য বিষয়
হল? জোন্স চালান হলেন জেলের ১৩ ফুট বাই ৬ ফুটের একটি অন্ধকার খুপরিতে। তিনি কবি।
কোন কাগজ কলমও তাঁকে দেওয়া হতনা। নিজের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে প্রথম দুটি লাইন সৃষ্টি
করেছিলেন তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ The Revolt of Hindostan-এর। তিনি লিখলেন
–
In
part by force, but more by panic driven.
Victorious deluge! from a hundred heights
Rolls the fierce torrent of a people's rights,
And Sepoy soldiers, waking, band by band,
At last remember they've a fatherland!
Then flies the huxtering judge, the pandering
peer,
The English pauper, grown a nabob here!
লিখলেন –
A
mighty shadow, deep, and stern, and still.
Threw o'er the fleet and flood each Indian hill;
The encampment's flag just reached the rising light,
Like lingering glory of the evening's fight:
One hour its last farewell majestic waved
Old England's pride, unchallenged and unbraved;
But a soft wind at sunrise, like God's hand,
Quietly bent it homeward from that land!—
Sad wound the weary numbers to the sea,
The signal's up, and Hindostan is free!
সাগরপারের একজন অবরুদ্ধ কিন্তু অনবদমিত কবি ও সংগ্রামী রুদ্ধকণ্ঠ উপনিবেশের
মানুষকে জানিয়ে দিলেন – তুমি মুক্ত হবে। জানিয়ে দিলেন ইংরেজ ভিখারিরা ভারতে এসে
নবাব বনে যায় (The
English pauper, grown a nabob here)। কি তীব্র শ্লেষ!
কি তীক্ষ্ণ ও মরমী ভালোবাসা মানুষের জন্য! মনে রাখতে ১৮৫৩ সালে লেখা এ কবিতার ৯
বছর পরে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। (Thierry
Drapeau, (4 January 2019). “The Roots of Karl Marx's Anti-Colonialism”. Jacobin (magazine). Retrieved
5
March 2019.
)
রাষ্ট্রকে বুড়ো
আঙুল দেখিয়ে শেলী লিখলেন England in
1819।রাজতন্ত্র, রাজপরিবা এবং এদের স্তাবকদের জন্য ঘৃণা
ও বিদ্রুপের কি সম্ভার সাজিয়ে দিলেন কবি!
An old,
mad, blind, despised, and dying King;
Princes,
the dregs of their dull race, who flow
Through
public scorn,—mud from a muddy spring;
Rulers
who neither see nor feel nor know,
…….
A
senate, Time’s worst statute, unrepealed—
Are
graves from which a glorious Phantom may
Burst,
to illumine our tempestuous day.
ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র-গণতন্ত্র কবাডি খেলার প্রধান
দুই দল টোরি আর হুইগদের নিয়ে লিখলেন অবিস্মরণীয় Similes
For Two Political Characters of 1819।
লিখলেন - As
from an ancestral oak
Two empty ravens sound their
clarion,
Yell by yell, and croak by
croak,
When they scent the noonday smoke
Of fresh human carrion:--
শুধু এটুকু নয়। কবিতাটি শেষ হচ্ছে - Are
ye, two vultures sick for battle,
Two scorpions under one wet
stone,
Two bloodless wolves whose dry
throats rattle,
Two crows perched on the
murrained cattle,
Two vipers tangled into one.
এ প্রবন্ধের চিন্তাঋদ্ধ পাঠকেরা ভাবুন রুদ্ধকণ্ঠের জন্য একক
ব্যক্তির মুক্তচিন্তার অমিত প্রকাশচ্ছটা। কিন্তু এঁদের এই প্রকাশ মার্ক্সের সতর্ক
বাণীর মতো নয় - It is very convenient to be “liberal”
at the expense of the middle ages. (Capital, I, chapter 27)। জোন্স কিংবা শেলী ভারতের ওপরে নিপীড়নের সাথে একধরনের নৈতিক ও আত্মিক একাত্মতা
অনুভব করেন, এবং সেটা সৎ।
বীরেন্দ্র আমাদের জানান –
মুখে যদি রক্ত ওঠে
সে-কথা এখন বলা পাপ। এখন চারদিকে শত্রু, মন্ত্রীদের
চোখে ঘুম নেই,
এ-সময়ে রক্তবমি করা পাপ; যন্ত্রণায় ধনুকের মতো
বেঁকে যাওয়া পাপ; নিজের বুকের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে
থাকা পাপ।
বীরেন্দ্র আমাদের আরেক ভয়-ধরানো জগতে নিয়ে যান। অন্ন,
কেবলমাত্র অন্নের কাহিনী শোনান মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা বিজন ভট্টাচার্য কিংবা
মহাশ্বেতা দেবীর মতো।
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির-আকাশে
কারা যেন আজো ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।
আর আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,
প্রার্থনায়, সারারাত।
কিংবা
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা;
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।।
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মাসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওংকার।
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।।
এরপরেই আমাদের হাত ধরে নিয়ে যান এক শুভ্র, ক্লেদহীন
জগতের দুয়ারে। এক
স্বপ্নসন্ধানও বটে –
কোথাও মানুষ ভাল রয়ে গেছে ব’লে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজ শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমণীকে বুকে টানে; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।
আবার এক ঝাঁকুনি দেন নিজেকে, তাঁর পাঠককে, পাঠক-বাহিত
হয়ে সমস্ত মানুষকে –
কার পাপ আমাদের রক্তের ভিতর;
কার অন্ধকার?
কণ্ঠস্বর
ভেসে আসে, ‘জোর যার’…
মানুষ কি এখনো তোমার
চোখ-রাঙানো প্রেমের চাকর?
অথচ কোথায় যাব? এ পৃথিবী আমার, তোমারো
‘মারো! যতো পারো!’
“এ পৃথিবী আমার, তোমারো” এ কাহিনী
১৮৩৫ সালের পটভূমিতেও লেখা হয়েছিলো। ১৮৩৫ সালে লেখা একটা প্রবন্ধ/বই-এর
উদাহরণ আমাদের কাছে আছে – A Journal of Forty-Eight Hours of the
Year 1945। লেখক হিন্দু কলেজের ছাত্র কৈলাশ চন্দ্র
ঘোষ। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল Calcutta Literary Gazette (or, Journal
of Belles Letters, Science, and Arts)-এ (vol. III, new
series, number 75, June 6, 1835)। দীর্ঘ কাহিনীতে
না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায় এ গল্পের নায়ক ২৫ বছরের যুবক ভুবনমোহন এবং তার দুজন
বিশ্বস্ত সাথী হল গঙ্গানারায়ণ এবং পার্বতীচরণ। এ গল্পের সময় ভাইসরয়ের নামও
তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেওয়া হয়েছে Lord Fell Butcher এবং তার সামরিক
জেনারেলের নাম John Blood-Thirsty। হিন্দু কলেজের
হোস্টেলে (১৯৪৫-এ নামকরণ হয়ে গেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, যদিও ১৮৩৫-এ লেখা বলে
কৈলাশচন্দ্র ঘোষ এ নাম জানতেন না) এক অসম যুদ্ধের কাহিনীর বর্ণনা আছে। কর্নেল
ভাইসরয়কে ২৫ জন গোরা সৈন্যের মৃত্যু ও ২৫ জনের আহত হবার সংবাদ দিচ্ছে। কিন্তু
দেশপ্রেমিক বিদ্রোহীরা মারা গেছে ৬ জন, ১৩ জন আহত। যুদ্ধ শুরু হবার আগে ভুবনমোহন
ইংরেজ প্রতিনিধিকে স্পষ্ট স্বরে, নিরুদ্ধ কণ্ঠে জানায় – “Worthy
Magistrate, I am sorry we are not able to comply with your proposition; we defy
you to do your worst. You see before you men who will neither be terrified by
the neighing of a steed, the waving of a sword nor the flashing of a gun. We
are determined to assert our liberties, when every other resource has failed,
by the strength of our arms. Go tell them that sent thee that we have resolved
to hurl Fell Butcher from his seat, we have renounced the allegiance of the
feeble and false Harry of England, and that we mean to abide by our own laws
and parliaments!”
আমাদের এসময়ে শেলী এবং জোন্সের কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই!
শেষ অবধি অসম স্বাধীনতার যুদ্ধে ভুবনমোহন ও তার বাহিনী হেরে
যায়। আক্ষরিক অর্থে যূপকাষ্ঠে তাকে প্রাণ দিতে হয়। তাকে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাবার
মূহূর্তে তার শেষ কথাগুলো ছিল – “আমার সহযোদ্ধা এবং দেশবাসী! জন্মভূমির বুকে
মৃত্যু হবার সান্ত্বনা বহন করছি আমি। আর যদিও বধ্যভূমিতে আমার জীবন দেওয়াই ছিল
ঈশ্বরের অভিপ্রায়, সহযোদ্ধাদের উপস্থিতি আমার শেষ মুহূর্তগুলোকে আনন্দোচ্ছল করে
তুলেছে। দেশরক্ষার জন্য আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু আমি ঢেলেছি এবং যদিও এখন সেই
ক্ষণ সমাগত যে আমার ভঙ্গুর দেহকাঠামোর মধ্যেকার দুর্বল জীবন-স্ফুলিঙ্গ আমাকে ছেড়ে
চলে যাবার মুখে, আমার আশা যে গৌরবোজ্জ্বল পথের সূচনা তোমরা করেছ সে পথেই তোমরা
হাঁটবে।” ভাইসরয় এরকম বীরত্বের সঙ্গে পূর্বপরিচিত ছিলনা, যেমন নগ্ন দ্রৌপদীর উপচে
পড়া তেজ দেখতে একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা “সেনানায়ক”। এভাবেই সময়ের বদল হলেও কিছু
কাঠামো আর উপাদান হাজারো সংস্কারের পরেও একরকমই রয়ে যায়। যাহোক, “While
he (ভুবনমোহন) was
going on in this strain, the viceroy struck with awe at the energy of the young
patriot, dispatched an officer to conclude the scene immediately.” নিরুদ্ধ কণ্ঠের এই অবারিত দার্ঢ্য বহন করা রাষ্ট্রের
পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য, “His hands were
powerfully arrested, his head forcibly thrust between two wooden pillars and
severed from his body at a single blow.”.(প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ভারতে ১৮৫৭ পূর্ববর্তী সময়ে
প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রকাশ্যে ফাঁসীতে ঝোলানোর ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার খুব
আগ্রহীছিলোনা, বিশেষ করে ১৮৩৫ সালে তো নয়ই। এখানে লেখকের মাথায় ফ্রান্সের
গিলোটিনের ছবি কাজ করেছে বলে মনে হয়।)
ঠিক এর প্রতিরূপ হিসেবে এরপরেই বীরেন্দ্র লেখেন –
আসমান ছেয়ে গেছে
পতাকায়, ফেস্টুনে, গর্জনে;
মনে হয় দৃশ্যের দর্পণে
বুঝি দ্রুত পৃথিবী বদলায়!
কূয়াষায়
ও শুধু চোখের ভুল, যা দেখিস,
ভিক্ষার মিছিল যায়।
কে আর আজ ছেঁড়াখোঁড়া পোষাকে আমাদের সবার সাথে –
ছাত্র-যুব-বৃদ্ধ-শিশু-নারী-অশক্ত – হেঁটে বন্দীমুক্তির গান গাইবেন? কে আজ বন্ধ
কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়বেন? কে আজ এমন কবিতার চাবুক মারতে পারে আমাদের?
চারপাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। দূরে শতবর্ষ প্রাচীন বেঙ্গল কেমিক্যালস বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে। আমরা ভার্চুয়াল সই সংগ্রহ করছি। আমাদের চাবকে দেবার কেউ নেইতো! আমাদের
বিবেক বুঝি তরল নাইট্রোজেনে শোয়ানো আছে। মণিভূষণ ভট্টাচার্য আমাদের জানিয়েছিলেন –
কিভাবে মানুষ এশে লাথি মেরে উল্টে দেবে বাণিজ্য নগর
কেড়ে নেবে সব –
নদীপথ অস্ত্রাগার ফলের বাগান নম্র প্রসূতিসদন
আয়ুর সুদীর্ঘ অধিকার,
বীরেন্দ্র আমাদের পড়তে বলেন –
তুমি অন্ধ! তাই গাছের পাতায় কালো ছায়া দেখ, গোলাপেও
পুলিশের
গন্ধ পাও, যে সুবাস পবিত্র, নিহত পশুর রক্ত। যার চোখ
আছে, দেখে
কলকাতায় পার্কে ময়দানে রাজভবনে অথবা এঁদো গলির
বস্তির
মুখ আলো করে
যেখানে যা বৃক্ষ আছে, ঈশ্বর-প্রতিম তারা,
স্বদেশ-প্রেমের দীপ্ত মহিমায়
জ্বলে যেন ত্রিবর্ণ পতাকা!
আমাদের কাছে নতজানু হয়ে বীরেন্দ্র, হয়তো বা সজল চোখে,
একটুখানি মিনতি করেছিলেন –
মানুষ রে, তুই সমস্ত রাত জেগে
নতুন করে পড়,
জন্মভূমির বর্ণপরিচয়!
পায়ের নীচে তোর
গভীর হচ্ছে চোরাবালির চেয়ে ভীষণ
ঘুমের শূণ্যতা,
তুই
সারাজীবন শিখলি পরের মুখের কথা,
শুধুই কথা!
রাজেশ্বরী জননী তোর তাই উপোসে
রাত্রি কাটায়
বোঝে না তোর মুখের ভাষা
আমরা বীরেন্দ্র চট্টোপাধায়কে প্রত্যাখান করেছি। বড়ো
অভিমানী মানুষ তিনি। আরেকবার হাত ধরে ডেকে আনা যায় না?